ঈদ-উল-আযহা এর তাৎপর্য ও শিক্ষা

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:

وَ لِکُلِّ اُمَّةٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا لِّیَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ عَلٰی مَا رَزَقَهُمۡ

বাংলা অনুবাদঃ-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন । (সূরা আল হজ্ব , আয়াতঃ ৩৪)

মুসলিমদের অন্যতম বৃহৎ উৎসব কুরবানীর ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানীর ঈদ। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু হওয়া এ কুরবানীর মূল শিক্ষাই হল সকল প্রকার যুক্তি ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর হুকুম আহকামের  প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ করা। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের নমুনাস্বরূপ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজ প্রিয় পুত্র হযরত তাদেরকে দান কে ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহর হুকুমের প্রতি অতিশয় আনুগত্যের কারণে আল্লাহ্তায়ালা তার এ কুরবানীকে কবুল করে নেন, এ ঘটনা আল্লাহর হুকুমের পূর্ণ আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।

ঈদ-উল-আয্হা ও কুরবানী

হজের মৌসুমে উদযাপিত এ ঈদকে ইসলামী পরিভাষায় ঈদুল আযহা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) একে ঈদ-উল-আযহা নামে নামকরণ করেছেন। এছাড়া ইয়াওমুন নহরও বলা হয়। জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও উপসাগরীয় অধিবাসীরা এ ঈদকে ‘ঈদ-উল-কাবীর’ বা বড় ঈদ নামেও সম্বোধন করে থাকেন। বাহরাইনের লোকেরা ‘ঈদ-উল-হুজ্জাজ’ বা হাজীদের ঈদ নামে সম্বোধন করেন। আর ইরান, আফগানিস্তানসহ এ উপমহাদেশের লোকেরা ‘ঈদ-উল-কুরবানী’ বা কুরবানীর ঈদ নামে অভিহিত করেন।

 আয্হা শব্দটিকে আরবীতে ‘কুরব’ও বলা হয়ে থাকে, যা ফারসি বা উর্দুতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে। কুরব-এর শাব্দিক অর্থ হল নৈকট্য অর্জন করা, কাছাকাছি যাওয়া। পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ ওই মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়। প্রচলিত অর্থে, ঈদ-উল-আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরয়ী তরীকায় যে পশু যবেহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়।

কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ- কুরবানীর গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদীস এ ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে লক্ষ করে বলেনঃ  فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

 বাংলা অনুবাদঃ- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।’ (সূরা কাওসার, আয়াতঃ ২)

অবিশ্বাসী-মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ এ আয়াতের মাধ্যমে মুসলিমদের আল্লাহর জন্য সালাত আদায়ের ও তার উদ্দেশ্যে কুরবানী করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। মুফাসসিরদের কারও কারও মতে, এ আয়াতে বিশেষভাবে ঈদ-উল-আযহার নামায ও নামায শেষে কুরবানীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ-

 وَ الۡبُدۡنَ جَعَلۡنٰهَا لَکُمۡ مِّنۡ شَعَآئِرِ اللّٰهِ لَکُمۡ فِیۡهَا خَیۡرٌ

বাংলা অনুবাদঃ- ‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা হজ, আয়াতঃ ৩৬)

আল্লাহ্তায়ালা আরও বলেনঃ-

وَ فَدَیۡنٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِیۡمٍ & وَ تَرَکۡنَا عَلَیۡهِ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ

‘আর আমি তাঁর (ইসমাঈলের পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমি এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম।” (সূরা সাফফাতঃ ১০৭ ও ১০৮)

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেনঃ- ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়। (সুনানু ইবনে মাজাহ)

তিনি আরও বলেনঃ- ‘যে ব্যক্তি প্রফুল্লচিত্তে কুরবানী আদায়ের নিয়তে কুরবানী করে, কিয়ামতের দিন তার এবং জাহান্নামের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি হবে।’ (বায়হাকি) এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইব্রাহীম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে।

এ ছাড়া মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত আদম (আঃ) হতে পৃথিবীর সব জাতিই কোনও-না-কোনও পদ্ধতিতে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করেছেন। এ ইতিহাসের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ্তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেনঃ-

 وَ لِکُلِّ اُمَّةٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا لِّیَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ عَلٰی مَا رَزَقَهُمۡ

বাংলা অনুবাদঃ-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এ বিশেষ রীতিপদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেসব আল্লাহ্ তাদেরকে দান করেছেন’। (সূরা আল হজ আয়াতঃ ৩৪)

কুরবানীর মৌলিক শিক্ষাঃ-

কুরবানীতে মুমিনের জন্য অসংখ্য শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে।

১। তাওহীদ প্রতিষ্ঠাঃ- মহান আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নামেই পশু কুরবানী দেওয়া হয়। জগতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেখানে তাদের মনগড়া উপাস্যদের নামে কুরবানী করে, সেখানে মুসলিম সমাজ কুরবানী দেয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

২। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণঃ– কুরবানীর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সকল আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেওয়াই হল পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। ঈদ-উল-আযহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হযরত ঈসমাইল (আঃ)-এর এরূপ পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কুরআনুল কারীমে দেখতে পাই।

৩। ইখলাস বা একনিষ্ঠতাঃ- সকল কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা -বর্জিত ইবাদাত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কুরবানীও একমাত্র আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

যেমন মহান আল্লাহতায়ালার আদেশঃ-

لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰکِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی

বাংলা অনুবাদঃ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালার নিকট কুরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না। তার নিকট তোমাদের তাওয়া (ইখলাস) পৌঁছায়।’ (সূরা হজ, আয়াত: ৩৭)

ইখলাসপূর্ণ কুরবানী হওয়ার কারণেই আল্লাহ্ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর কুরবানী কবুল করে নিয়েছিলেন।

৪। তাওয়াভিত্তিক জীবনযাপনঃ– কুরবানীর সুমহান শিক্ষা তাওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহতায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশ ঘটেছে। হযরত আদম-পুত্র হাবিলের কুরবানী আল্লাহতায়ালা কবুল করেছিলেন তাওয়ার প্রভাবের কারণেই।

৫। দরিদ্র ও অনাথের সুখে-দুঃখে অংশীদারঃ- কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আযহার নামাযে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-ইয়াতিমের মধ্যে কুরবানীর গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার রয়েছে।

কুরবানী মুসলমানদের শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহীদী আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে এবং ইখলাস ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

লিখেছেন: সিয়াম আহমাদ
শিক্ষার্থী
গাবাটি এ, এইচ, এম সিনিয়র মাদরাসা।

Rate this post