নকশবন্দী তরীকার মহান বুযুর্গ শায়খ মাহমুদ এফেন্দি (র.) : তুরস্কে ইসলামী পূনর্জাগরণের অন্যতম রাহবার।

২০০৫ ঈসায়ি। উমরাহের মৌসুম। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করে করে একই সুরে তালবিয়া পড়ছেন আল্লাহর ঘরের মুসাফিররা। এই মুসারফিরদের বেশিরভাগই একটি বিশাল কাফেলার সদস্য। তাদের সংখ্যা ত্রিশ হাজার। শুভ্র কায়ার সফেদ কাপড় পরিহিত এক বুজুর্গ তাদের প্রধান। এক কাফেলায় এত সংখ্যক বাইতুল্লাহর মুসাফির বেশ অবাক করা বিষয়। কিন্তু মুসাফিরদের দেশের পরিচয় তুরস্ক জেনে সকলেই আরও বিস্মিত হয়ে যান। এটাতো সেই দেশ, যেখানে ১৯২৪ ঈসায়িতে উসমানি খিলাফত ধ্বংস করে কামাল আতাতুর্ক পাশা যখন পুরোদস্তুর সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, তখন ধর্মনিরপেক্ষতার নামে চলে ইসলামের নাম নিশানা মিটিয়ে দেওয়ার মিশন। কয়েক যুগ চলতে থাকে প্রকাশ্যে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়ের উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা৷ আযান, নামায, পর্দা, দাড়ি-টুপি সহ ইসলামিয়াতের সবকিছুই ছিল নিষিদ্ধ। শুধু সম্পৃক্ততার দায়ে কতজন আলেম আর জনসাধারণকে শহিদ করা আর নানা শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই দেশ থেকে তারা এসেছেন। শুধু বাইতুল্লাহর জিয়ারতকারী হয়েই আসেন নাই, বরং সকলেই আমলে-সুরতে পুরোপুরি ইসলামকে দীন মান্যকারী হিসেবেই এসেছেন। ত্রিশ হাজারের কাফেলা সেদিনই তুরস্কে আদতে ইসলামের পুনর্জাগরণের নতুন বার্তা দিয়ে যান। আজকের তুরস্কে ইসলামদ্রোহিতার বিরুদ্ধে যে দীনি জাগরণের নজরানা দেখা যাচ্ছে, তার পছনে যেসকল রাহবারের অবদান অনস্বীকার্য, তাদের একজন ছিলেন সেই কাফেলার সকলের পীর শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ। সুফি শায়খ আল্লামা মাহমুদ এফেন্দি নকশাবন্দি হানাফি মাতুরিদি রাহিমাহুল্লাহ। সুত্র: আল-জাযিরা
১৯২৯ সনে তুরস্কের তারবাজুন প্রদেশে উফি শহরের তুশানলি গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শায়খ মাহমুদ আফেন্দি। জন্মের পর পিতা শাইখ আলি এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ দুআ ও বরকত লাভের আশায় তাঁকে তুরবাজুন প্রদেশের তৎকালীন প্রসিদ্ধ আলেম ও বুজুর্গ শাইখ মাহমুদ রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট নিয়ে যান। শাইখ মাহমুদ এ নবজাতক শিশু কে কোলে নিয়ে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমার নাম হোক আমার মত মাহমুদ, তোমার ইলম হোক আমার ইলমের ন্যায় কিন্তু তোমার তাকওয়া হোক আমার তাকওয়ার চেয়ে বেশি।’ (সাফাহাতুন মুশরিকাতুন মিন হায়াতি মাওলানা মাহমুদ আফেন্দি নকশবন্দি, লেখক: শাইখ মুহাম্মাদ আলী আল মাসউদ)
সেই বুজুর্গ মাহমুদের দুআ আল্লাহ কবুল করে তাঁকে তুরস্কের হাদি বানিয়ে দেন। শাইখের পুরো নাম মাহমুদ উসতা উসমান উগলু। তুরস্কে মাহমুদ হাসাউসমানউগলু এবং মাহমুদ হাযরাতলেরি নামে প্রসিদ্ধ। মাহমুদ এফেন্দি মাত্র ছয় বছর বয়সে কুরআন কারীম হিফজ করেন। আরবি, ফারসি, সরফ-নাহু সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করেন শায়খ তাসবীহি এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর কাছে। ইলমে কিরাত ও কুরআন কারীমের নীতিশাস্ত্র শিখেন শায়খ মুহাম্মদ রাশীদ আশিক কুতলু এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট। আকীদা, তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও উসূল, অলংকারশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন সুলাইমানি মাদরাসার শিক্ষক তুরসুন ফাউযি এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর তত্ত্বাবধানে। শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন আকীদায় মাতুরিদি। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা লালনকারী মৌলিক দুটি ধারার একটি । তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে নকশবন্দিয়া তরীকার অনুসারী। ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফি। তাঁর শায়খ আল্লামা তুরসুন রাহিমাহুল্লাহ শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর উলুমে আকলি (বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) ও উলুমে নকলি (কুরআন-হাদীস)—উভয়টিতে ঈর্ষণীয় পাণ্ডিত্য দেখে ১৬বছর বয়সেই সব বিষয়ে প্রত্যেকটি শাখার পাঠদানের অনুমতি প্রদান করেন। পাঠদানের ইজাযত পেয়ে নিজের গ্রামে মাহমুদ এফেন্দি ইমামতি শুরু করেন। শিশুদের পাশাপাশি জনসাধারণকে দীনের দিকে আহবান করতে থাকেন। বছরের কয়েক সপ্তাহ নির্দিষ্ট রাখতেন সফরের জন্য। তখন দেশ-বিদেশে দীনি মৌলিক বিষয়ে তূলনামূলক বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। ১৯৫২ সালে তিনি তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি অর্জনে তাসাওউফের দীক্ষা নিতে তরীকায়ে নকশবন্দিয়া কামশানামাওয়ানিয়া (النقشبندية الكمشنماونية)এর শায়খ সুফি আহমদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট দীক্ষা নেন। পরবর্তীতে স্বপ্নযুগে আদিষ্ট হয়ে নকশবন্দিয়া তরিকার খালিদিয়া ধারার সবক নিয়ে শাইখ আলি হায়দার আখসাখাওয়ি (الأخسخوي) এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট মুরীদ হন। যিনি ছিলেন উসমানী খিলাফতে চার মাযহাবের মুফতি। শাইখ যাহিদ আল-কাওসারি রাহিমাহুল্লাহ আলী হায়দার এফেন্দিকে শাইখ হিসেবে মান্য করতেন। তিনি বলতেন, ‘যদি চারও মাযহাবের ফিকহের কিতাব ধ্বংস হয়ে যায়, আমি আমার হিফজ থেকে আবার সবগুলো সংকলন করতে পারবো।’ (সুত্র:সাফাহাতুন মুশরিরাকুত মিন হায়াতি মাওলানা মাহমুদ এফেন্দি নকশবন্দি)
শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর দ্বীনি শিক্ষাগ্রহন এবং পাঠদানের সে সময়টা ছিলো তুরস্কে ইসলামের জন্য একিবারে বৈরিকাল। তৎকালীন সরকার মসজিদ মাদরাসা বন্ধ করে তা পরিত্যক্ত রাখত বা বিক্রি করে দিত। সেখানে যাতায়াত, দীনি কার্যক্রমের কোনো আলামত দেখা মাত্রই থাকত কঠিন শাস্তি। যেহেতু দেশের জনগণ ও প্রশাসন—উভয়টি ইসলাম থেকে অনেক আগেই দূরে সরে গেছে, কাজেই সেক্যুলার রীতির বিরুদ্ধে শতভাগ অবস্থান না নিয়ে শাইখ এফেন্দি নির্দিষ্ট পদ্ধতি গ্রহণ করেন-
• মুসলমানকে যথাসম্ভব দীনের পথে ফিরিয়ে আনা,
• ব্যক্তিউদ্যোগে খবুই একান্তে ও কৌশলে ফরজ ধর্মীয়শিক্ষা চালু রাখা এবং
• আধুনিক সমাজব্যবস্থা তথা ডেমোক্রেসি, ন্যাশনালিজম, কমিউনিজম, সেক্যুলারিজম—প্রত্যেকটির ঠুনকো যুক্তি, নড়বড়ে ভিত ও অপরিণামদর্শী ফলাফল জনগণের সামনে তুলে ধরে নামধারী সেক্যুলার মহলের বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা করা।
শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রহ. ১৯৫৩ সালে দাওয়াতের পরিসরকে বেগবান করতে জন্মভূমি ছেড়ে ইস্তাম্বুলে চলে যান। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় ইসমাইল আগা নামের একটি মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আত্মিক পরিশুদ্ধিতার জন্য নকশবন্দিয়া তরিকা চর্চাকারীদের নিয়ে গঠিত ইসমাইল আগা জামায়াত নামটি এই মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত। আমৃত্যু তিনিই ছিলেন জামাতের প্রধান। ১৯৫৪ ঈসায়ি থেকে এই মসজিদ কেন্দ্রিক তালীম-তারবিয়াতের দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৬ ঈসায়িতে ইমামতি থেকে অবসরে যান। ইমামতি থেকে অবসরে গেলেও দীনের রাহবারির দায়িত্ব শেষ হয় নি। আমরণ সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইসমাইল আগা মসজিদের দায়িত্ব নেওয়ার পর ভয়ে মুসাল্লি না আসাসহ অনেক মুসিবত আসতে লাগল। আস্তে আস্তে সবার কাছে গোপনে দাওয়াত দেন, তিনি কেবল রবের সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই মসজিদ পূণরায় চালু করেছেন। খুবই ধীরে, ধীরে মুসল্লির সংখ্যা পনের হয়৷ উদ্যমী হয়ে শিশুদের দীনি তারবিয়ত দেওয়ার জন্য চালু করেন হিফজখানা। এভাবে সবাইকে হালাল-হারাম, জায়েজ-নাজায়েজ, এবং দ্বীনি বিধি-বিধান শিক্ষা দিতে থাকেন।অনেক সময় গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ইশারায় আরবি ভাষার ব্যাকরণ, নামাজ, রোযা সহ জরুরি দীনি মাসয়ালার শিক্ষা দিতে হতো। তুরস্কের কোথাও কোথাও এ ধারা এখনো চালু আছে বলে জানা যায়। এভাবে দেড়যুগ নিরবে নামাজ ও দীনি জরুরি তালিম শেষে একসময় মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। মানুষের অন্তরে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বতের বীজ বোপন করতে থাকেন। আত্মিক পরিশুদ্ধি তথা জীবন-মরণ সব আল্লাহর সন্তুষ্টির তরে বিলীন করাই দুনিয়ায় আগমনের স্বার্থকতা-এই শিক্ষা দিতে মানুষকে নকশবন্দিয়া তরিকায় তরবিয়াত দেয়া শুরু করেন।যিকির-আযকারে অভ্যন্ত করে তোলেন।
রাজধানী ইস্তাম্বুলের ফাতিহ আশপাশ হতে থাকে ধার্মিকদের এলাকা। কিন্তু তখন সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মদ্রোহীতার বদলে জনগণের ধার্মিক হয়ে যাওয়া দেখে তেলে বেগুনে জ্বলতে থাকে। তাকে দমানোর জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। নিষেধাজ্ঞা বহুরূপী হয়ে আসতে থাকে। এদিকে তার ভক্তমুরীদের সংখ্যাও বেড়ে চলে। নিষেধাজ্ঞা শুধু শায়খ মাহমুদ এফেন্দি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তার সাথে সম্পর্কিত মুরীদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। তবুও তারা কেউ দমে যাননি। এমনকি ধর্মদ্রোহিরা এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর উপর হামলা করে একাধিকবার। তিনি নিজে খোদার প্রেমের শুধা পান করে যেভাবে রবের ভালোবাসায় নিবিষ্ট ছিলেন, ইশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে নিজে মগ্ন হয়ে থাকতেন, সেভাবে তার ভক্ত মুরীদদেরও এই সবক দিয়ে দীনের পথের জানবাজ একটি কাফেলায় পরিণত করেন। মুরিদগণ নিজে শাইখের পথ অনুসরণ করে সে আলো ছড়িয়ে দেন শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
তাঁর আধ্যাত্মিক সংগঠন ইসমাইল আগা জামাত যা জামাতে মাহমুদ এফেন্দি নামেও পরিচিত; নিরবে দাওয়াত চালাতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই তাঁর মুরীদগণ তুরস্কে সুন্নাতের অনূসরণ করেছেন, যে সময় ইসলামের নুন্যতম অনুসরণ এমনকি ইসলামী নিদর্শন দাঁড়ি-টুপি, জুব্বা, পর্দা মেনে চললে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো৷ তখন অশ্লীলতা, বেপর্দা, মদ, জুয়া সহ যাবতীয় ইসলামবিরোধী কাণ্ড ছিল হাতের নাগালে এবং যুগ যুগ ধরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তা সামাজিক কালচারের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। ঠিক সে সময় তারা ইসলামকে দেহ-মন এবং আচার-ব্যবহারে ধারণ করেছেন। এই ধর্মহীনতার পরিবেশের বাহানায় আধুনিক ইসলামের নামে কোনো বিকৃতিকে স্বীকৃতি দেননি। তারা সামাজিক রীতিনীতির সবকিছুতেই দীনচর্চা অব্যাহত রাখেন। এই জামাতের অন্তর্ভূক্ত নারীগণ হিজাব পরেন, শরীর ঢেকে শুধু হাত, পা এবং চোখ খোলা রাখেন। এজন্য যে লেবাস পরেন তার স্থানীয় নাম ‘শারশাফ’। আর পুরুষেরা নির্দিষ্ট জুব্বা, পাগড়ি বা টুপি পরিধান করেন। তারা আরবি ব্যাকরণ আয়ত্বে এনে কুরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষা আরবি মাধ্যমেই দীনি ইলম আহরণ করে থাকেন। ফলে তুর্কি তাদের মাতৃভাষা হলেও অনেকেই আরবিতে স্পষ্ট কথা বলতে পারেন। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ জেলা সহ আশপাশে ইসলামের ছায়া দিন দিন আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসব এলাকার অধিবাসীর দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম খুবই আপন হয়ে ওঠা দেখে তুরস্কের আর.পি.পি পার্টির জৈষ্ঠ্য রাজনৈতিক ডেনিজ বেইকাল (Deniz Baykal) ফাতিহ জেলাকে বলেন, ‘এ ফাতিহ জেলা যেন পুরোটাই ইসমাইল আগা রিপাবলিক।’
শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ হলেন উসমানী খিলাফত পরবর্তী কামাল পাশা সরকারের ইসলাম বিরোধী পদক্ষেপের প্রতিরোধে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের রূপকার শায়খ বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসি রাহিমাহুল্লাহ এর পরবর্তীতে সে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার অন্যতম ধারক। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শায়খ নাজিম হাক্কানি নকশবন্দী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন তার অন্যতম বন্ধু। তারা প্রত্যেকেই দীনের ভিত গড়তে কাজ করে গেছেন, কিন্তু কাংখিত লক্ষ্যের দৃশ্যমান যাত্রা শুরু হয় শায়খ মাহমুদ এফেন্দির সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা সম্বলিত দীনি দাওয়াতের হাত ধরেই। মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ শুধু ধার্মিক আমজনতার উপরই প্রভাব বিস্তারকারী ছিলেন না, বরং শায়খ দ্বারা উচ্চশিক্ষিত, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গও প্রভাবিত হয়েছেন।
বর্তমান তুরস্কে সেক্যুলারদের সাথে লড়াই করে ইসলামীকরণের যে ঝোঁক ও প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর মত রাহবারদের আধ্যাত্মিক প্রভাবেরই একটি ফলাফল। কারণ রাজনৈতিক দলের অনেক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীও দীনি ক্ষেত্রে মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ থেকে প্রভাবিত। বলা হয়ে থাকে তুরস্কের ইসলামী আন্দেলনের অন্যতম রুপকার নাজমুদ্দিন আরবাকান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যিব এরদোগান তার আধ্যাত্মিক চেতনায় অনুপ্রাণিত। বিশেষত এরদোগান তার দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। কারণ তিনি কুরআন যে শায়খের কাছে শিখেছেন সেই শায়খ কামাল এফেন্দি হলেন মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর ঘনিষ্ঠ ছাত্র। পাশাপাশি এরদোগান দুআ ও নসিহত গ্রহনের জন্য শায়খের নিকট যেতেন। মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর লাশ নিজ কাঁধে বহন করার মধ্য দিয়ে শায়খের প্রতি তার ভালাবাসার মাত্রা অনুমান করা যায়। বিভিন্ন বার্তা সংস্থার বরাতে জানা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে মধ্যমপন্থী ও আধুনিকায়নে বিশ্বাসী ধর্মীয় গুরু ফেতুল্লাহ গুলেন থেকেও রাজনীতি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর ভাবশিষ্য বেশি। অথচ, মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ বা তার আধ্যাত্মিক সংগঠন ইসমাইল আগা জামায়াত প্রচলিত রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। (সূত্র: আল-জাযিরা)
শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ তাযকিয়াতুন নফস, দাওয়াত, তালীম-তরবিয়ত, ধর্মদ্রোহিদের খণ্ডন করার পাশাপাশি অনেকগুলো কিতাব রচনা করেছেন। যেমন, রূহুল ফুরকান (১৯ খণ্ড), মুহাদিসাত (৯খণ্ড), রিসালাতুন কুদসিয়্যাহ (২খণ্ড), সুহবতে উমার, তাফসীরু সুরাতিল ফাতিহা’ ইত্যাদি।
শাইখ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর কতিপয় বাণী:
★ মুত্তাকি হলো তেমন, যাকে এক ওয়াক্ত নামাজ ত্যাগ করার জন্য পুরো দুনিয়া হাতের মুঠোয় এনে দিলেও সে বলবে, আমার এক ওয়াক্ত নামাজ তোমাদের এই নশ্বর দুনিয়া থেকে উত্তম।।
★ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চার হাজার সুন্নাত রয়েছে। আমি যদি সেগুলো থেকে চারটি সুন্নাতও পরিত্যাগ করি, তোমরা আমার পিছনে নামাজ পড়ো না! (কোনো কোনো সময় তিনটির কথাও বলেতেন)।
★ আবু জাহল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল, কিন্তু তোমরা তোমাদের অন্তর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সরিয়ে দিয়ে আবু জাহলের মতো হয়ো না!!
★ মানুষের জন্য ওয়াজিব হল, নিজের ভুলগুলো অবলোকন করা৷ তার উচিত নয় অন্যের দোষ তালাশ করে নিজের বেলায় ভুলে যাওয়া।’
★ মহত্বের বিষয় হবে, আপনারা গুনাহগার বান্দার প্রতি দয়াপ্রবণ হবেন, তাদেরকে অবজ্ঞা করে দূরে সরাবেন না বরং তাদেরকে জাহান্নামে পতিত হওয়া থেকে বাচাতে প্রয়োজনে বিনয়ী হোন।
★ শিক্ষক ও মুরশিদ ছাড়া ইলম হাসিল করা যায় না।
★ যদি ইস্তাম্বুলের প্রতিটি ঘরে ঘরে দীনি দরসগাহ হয় আর সেখানে সৎ কাজের আদেশ এবং অসত কাজে নিষেধ করার শিক্ষা না থাকে, তাহলে সে সব দরসগাহের কোনো ফায়দা নেই,
★ কারামতের ব্যাপারে প্রশ্ন জরা হলে, তিনি বাহাউদ্দীন নকশবন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর সেই বাণীতে জবাব দিতেন, ‘ ইস্তেকামাত থাকাই হল কারামাতের মূল(ফরজ ও সুন্নাত না ছাড়া, গুনাহের কোনো কাজ না করা)। (সুত্র: সাফহাতুন মুশরিকাতুন মিন হায়াতি মাওলানা মাহমুদ আফেন্দি)
তুরস্কসহ সারাবিশ্বে শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর মুরিদের সংখ্যা ৬০লক্ষেরও বেশি বলে বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর বার্তা সংস্থা উল্লেখ করেছে। জর্ডান ভিত্তিক ‘রয়্যাল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার (আরআইএসএসসি) প্রতিবছরের মতো এবারও তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকায় শীর্ষ পঞ্চাশের ভেতর তালিকাভূক্ত করে।
মক্কা মুকাররমার প্রখ্যাত শায়খ আল্লামা মুহাম্মদ আলাভী আল-মালিকী রহ., শায়খ মুহাম্মদ সা্ঈদ রামাদান আল-বুতী রহ., শায়খ মুহাম্মদ আলী আস সাবুনী রহ., শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ, শায়খ উমার আল হাবীব সহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সমকালীন শীর্ষস্থানীয় উলামা ও বুযুর্গদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল।
এ মহান বুজুর্গ ২৩জুন, বৃহস্পতিবার, ২০২২ ঈসায়ি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এই দুনিয়ার সফরের ইতি করে রাফিকে আলার সান্নিধ্যে চলে যান। ২৪জুন, জুময়াবার সুলতান আল ফাতিহ মসজিদে তার জাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মিডিয়ার তথ্যমতে জানাযায় ৩০লাখেরও বেশি মুরিদীন, উলামায়ে কিরাম, শুভাকাঙ্ক্ষী, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাধারণ মুসলমানের উপস্থিতি ছিল। জানাযার নামাজ পড়ান তাঁর বড় ছেলে শায়খ আহমদ হোজ্জা এফেন্দি৷ নামাজ শেষে দুআ পরিচালনা করেন দিয়ানাত ফাউন্ডেশনের প্রধান, তুরস্ক সরকারের ধর্মপ্রতিমন্ত্রী প্রফেসর ড. শায়খ আলী এরবাস। এসময় শায়খ মাহমুদ এফেন্দি রাহিমাহুল্লাহ এর তরিকতের সংগঠন ইসমাইল আগা জামাতের প্রধান ঘোষণা করা হয় তাঁর খলিফা হাসান এফেন্দি নকশবন্দীকে।
রাব্বে কারীম শতাব্দীর এই অন্যতম মুজাদ্দিদকে তার রহম চাদরে আবৃত করুন এবং সকল স্বপ্ন ও রেখে যাওয়া খেদমতে তারাক্কি দান করুন। আমীন!
লিখেছেন: ইমাদ উদ্দীন
Rate this post