নবিজির দেহ মুবারাক: সৌন্দর্য্যের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সাহাবিদের প্রসংশা

সৃষ্টিজগতে মানুষ জাতি হল সবার সেরা। মহীয়ান আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। শুধু মর্যাদায় নয়, দৈহিক আকৃতি এবং সৌন্দর্যেও এজাতিকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহর বাণীতে তাঁর ঘোষণা হল-
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ

আমি মানুষকে শ্রেষ্ঠ অবয়বে সৃষ্টি করেছি। (১)

এ আয়াতের মর্মার্থ সম্পর্কে কুরআন মাজীদের প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন ব্যাখ্যাগ্রন্থ “তাফসীরে কাবীর”-এ বলা হয়েছে-

في أحسنِ صُورةٍ واعتدالٍ على أحسنِ صورة وهيئةٍ

“সবচেয়ে মানানসই সুন্দর দেহ সবচেয়ে সুন্দর কাঠামোয়।” (২)

সৃষ্টির সেরা এই জাতির মাঝে সর্বোত্তম হলেন আল্লাহর মনোনীত নবি-রাসূলগন (আলাইহিমুস সালাম)। তারা জ্ঞানগরিমা,  মর্যাদা সহ দৈহিক সৌন্দর্যেও শ্রেষ্ঠ। আবার শ্রেষ্ঠ এই নবি-রাসূলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মর্যাদা ও সম্মানের শ্রেষ্ঠত্ব সকলের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু দৈহিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে এই শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অনেকের মনে সংশয় দেখা দেয়। এর মূলে হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখনিঃসৃত মিরাজের একটি হাদীস। সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ইউসুফ আলাহিস সালাম সম্পর্কে বলেন-
 هُوَ قَدْ أُعْطِيَ شَطْرَ الْحُسْن

“তাঁকে (ইউসুফ আলাইহিস সালাম) সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছে।” (৩)

হাদীস বিশারদদের মতে, এই হাদীস দ্বারা ইউসুফ আলাইহিস সালাম সবেচেয়ে সুন্দর—এটি বুঝায় না। তারা হাদীসের মর্মার্থ সহ অন্যান্য হাদীস দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মর্যাদার পাশাপাশি সৌন্দর্যের দিক দিয়েও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছেন।
সাহাবিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রাণাধিক ভালবাসতেন বিধায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শামায়েল তথা দেহ মুবারাক, আচার-ব্যবহার, পরিধেয় বস্ত্র, ব্যবহার্য জিনিসপত্র অর্থাৎ  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেক বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবলোকন করেছেন। আর পরবর্তীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট এসমস্ত বিষয়াদি খুবই যত্নের সহিত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম রূপে বর্ণনা করেছেন।  এক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দেহ মুবারাকের আলোচনা ছিল অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
আমরা আজকের প্রবন্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মর্যাদার পাশাপাশি  সৌন্দর্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ এবং  সাহাবিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্যের স্বীকৃতি দিতেন ও প্রশংসার করতেন, এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ। তবে এখানে সৌন্দর্যের  ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বলে রাখা উচিৎ যে, ইসলামে মানুষের মর্যাদা কখনই বর্ণ বা সম্পদের আধিক্যতায় বিবেচিত হয় না। বরং সম্মানিত হওয়ার মানদণ্ড হল তাক্বওয়া। যেমনটা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছে—
إن أكرمكم عند الله أتقاكم
‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম, যে তোমাদের মাঝে সর্বোচ্চ তাক্বওয়াবান।’ (৪)
আবার এ বিষয়টি  স্পষ্ট হাদীসেও এসেছে।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—‘হে মানবজাতি! জেনে রাখো! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের আদি পিতা এক। স্মরণ রেখো! অনারবির উপর আরবির এবং আরবির উপর অনারবির কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালো বর্ণের মানুষের জন্য লাল বর্ণের মানুষের উপর এবং লাল বর্ণের মানুষের জন্য কালো বর্ণের মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই।  তবে তোমাদের মধ্যে সে ব্যাক্তি সর্বোত্তম যে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ তাক্বওয়াবান।’(৫)
আমাদের আলোচনার কারণ হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নবি-রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) বিশেষভাবে মনোনীত, যারা মানুষের মধ্যে মর্যাদার বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ। সাধারণ মানুষের সাথে যাদের তূলনা করা বেয়াদবি ।  হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—‘আল্লাহ তায়ালা সকল নবিকেই সুন্দর আকৃতি এবং সুন্দর কন্ঠের অধিকারী করে বানিয়েছেন।’(৬) তাই নাবিগণ আলাইহিমুস সালাম হলেন মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রেণী। আর তাদের  মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি হলেন আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি আল্লাহর মনোনীত নাবি-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)-এর মধ্যে সৌন্দর্যের দিক থেকেও যে সর্বশ্রেষ্ঠ—আমরা এখানে এই বিষয়টি আলোচনা করছি। আর নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মুবারাকের সৌন্দর্যের আলোচনার রীতি যে নতুন নয়, বরং সাহাবিদের যুগেও তার প্রচলন ছিল এ সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরব। ইনশাআল্লাহ!
♦♦  মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি:
প্রথমে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মাঝে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ এসংক্রান্ত আলোচনা করব। শুরুতে সে হাদীস উপস্থাপন করতে চাই, যা থেকে সাধারণ দৃষ্টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে পারে। সেই হাদীসটির মর্মার্থ নিয়ে সালাফের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অন্যান্য হাদীস, সাহাবিদের বক্তব্য এবং ইসলামি পণ্ডিতগণের মতামত পেশ করা হবে।–
★ মিরাজের ঘটনা বর্ণনার হাদীসে এসেছে যে,মিরাজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ও ইউসুফ আলাইহিস সালাম উভয়ের মাঝে তৃতীয় আসমানে সাক্ষাত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইউসুফ আলাইহিস সালামা’র সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
هُوَ قَدْ أُعْطِيَ شَطْرَ الْحُسْن
 “তাঁকে (ইউসুফ আলাইহিস সালাম) সৌন্দর্যের অর্ধেক পরিমাণ দেয়া হয়েছে।” (৭)
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে সৌন্দর্যের অর্ধেক পরিমাণ যদি ইউসুফ আলাইহিস সালামকে দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে বাকি অর্ধেক সৌন্দর্য দেয়া হয়েছে সমস্ত মানুষকে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সেই অর্ধেকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মর্মার্থ এরকম নয়। এজন্য হাদীসের ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনদের মতামত দেখতে হবে।
  → উল্লেখিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওযি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৫৯৭ হিজরি) হাদীসের জটিলতার উপর তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ “কাশফুল মুশকিল মিন হাদীসিস সাহীহাইন”-এ বলেন-
قَالَ ابْن قُتَيْبَة: معنى كَونه أعطي شطر الْحسن أَن الله تَعَالَى جعل لِلْحسنِ غَايَة وَاحِدًا، وَجعله لمن شَاءَ من خلقه، إِمَّا للْمَلَائكَة أَو للحور، فَجعل ليوسف نصف ذَلِك الْحسن، فَكَأَنَّهُ كَانَ حسنا مقاربا للوجوه الْحَسَنَة، وَلَيْسَ كَمَا يزْعم النَّاس من أَنه أعطي نصف الْحسن وَأعْطِي النَّاس كلهم نصف الْحسن
“ইবনু কুতাইবা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ইউসুফ আলাইহিস সালামকে অর্ধেক পরিমাণ সৌন্দর্য দেয়ার অর্থ হল- আল্লাহ তায়ালা সৌন্দর্যকে একটি সীমানা তথা মাপকাঠি দিয়েছেন। তা থেকে তিনি সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা প্রদান করেন। হউক ফেরেস্তা বা জান্নাতের হুর (রমণী)। আল্লাহ ইউসুফ আলাইহিস সালামকে সেই মাপকাঠি অনুযায়ী অর্ধেক প্রদান করেছেন। এজন্যে তিনি অনেক সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। তবে বিষয়টি মানুষের ধারণা মত এমন নয় যে, ইউসুফ আলাইহিস সালামকে মোট সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছে এবং বাকি অংশ সমস্ত মানুষকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। (৮)
আল্লামা ইবনুল জাওযি রাহিমাহুল্লাহ ইবনু কুতাইবা রাহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্যকে সমর্থন করেন৷ এ মতে সৌন্দর্যের একটি মাপকাঠি আছে। সেই মাপকাঠির আলোকে আল্লাহ তায়ালা তা বন্টন করেন। তাই উনাদের মতে হাদীসের অর্থ হল, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর লাভ করা সৌন্দর্য সমস্ত সৌন্দর্যের অর্ধেক নয়, বরং সৌন্দর্যের  মাপকাঠি অনুযায়ী তার সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্যের অর্ধেকে পৌঁছেছে।
  → আল্লামা ইবনু কায়্যিম আল জাওযিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ “বাদাইউল ফাওয়াইদ”-এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-
قول النبي صلى الله عليه وسلم عن يوسف “أوتى شطر الحسن ” . قالت طائفة : المراد منه أن يوسف أوتي شطر الحسن الذي أوتيه محمد ، فالنبي صلى الله عليه وسلم بلغ الغاية في الحسن ، ويوسف بلغ شطر تلك الغاية .
“ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বক্তব্য ‘তাকে সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছে’ -এ ব্যাপারে একদল বলেন: ইউসুফ আলাইহিস সালামকে সৌন্দর্যের সেই অর্ধেক দেয়া হয়েছে, যেই সৌন্দর্য দেওয়া হয়েছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য সৌন্দর্যের মাপকাঠির চুড়ায় পৌঁছেছিলো আর ইউসুফ আলাইহিস সালামের সৌন্দর্য সেই মাপকাঠির অর্ধেক পৌঁছেছে।”

তিনি শেষে আরও বলেন-

حديث أنس لا ينافى هذا بل يدل على أن النبي صلى الله عليه وسلم أحسن الأنبياء وجها وأحسنهم صوتا، ولا يلزم من كونه أحسنهم وجها أن لا يكون يوسف اختص عن الناس بشطر الحسن واشتركوا هم في الشطر الآخر، ويكون النبي صلى الله عليه وسلم شارك يوسف فيما اختص به من الشطر وزاد عليه بحسن آخر من الشطر الثاني. والله أعلم
আনাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুর হাদীসটি এটি অগ্রাহ্য করে না (ইউসুফ আলাইহিস সালাম সৌন্দর্যের অর্ধেকের অধিকারী হওয়া), তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৈহিক সৌন্দর্য এবং কন্ঠ উভয় দিক থেকে শ্রেষ্ঠ–তা প্রমাণ করছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে সুন্দর মানুষ দাবিটি আবশ্যক করছে না যে, ইউসুফ আলাহিস সালাম সৌন্দর্যের অর্ধেকের অধিকারী এবং বাকি অর্ধেক সৌন্দর্যে সব মানুষ অংশীদার হন নাই। বরং ইউসুফ আলাইহিস সালাম যে সৌন্দর্যের অর্ধেক পেয়ে বিশেষায়িত হয়েছেন এবং এর বাকি অর্ধেক, এই দুই ভাগ মিলে সৌন্দর্য্যের পূর্ণতা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একত্রিতভাবে লাভ করেছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ ” (৯)
[নোট: আনাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুর হাদীস হল-

ما بعث الله نبياً إلا حسن الوجه، حسن الصوت، وكان نبيكم أحسنهم وجهاً، وأحسنهم صوتاً
‘আল্লাহ তায়ালা সকল নবিকেই সুন্দর আকৃতি এবং সুন্দর কন্ঠের অধিকারী করে বানিয়েছেন। আর তোমাদের নবি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সুমধুর কন্ঠের অধিকারী।’ শামায়েল তিরমিযি, হাদীস নং- ২৪৫ ]

→ আল্লামা যারকানি রাহিমাহুল্লাহ ‘মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা’-এর উপর ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন-
قال ابن المنير وغيره في حديث: (أُعْطِيَ يوسف شطر الحسن)،.  يتبادر إلى بعض الأفهام أنَّ الناس يشتركون في البعض الآخر، وليس كذلك، بل المراد أنه أوتي شطر الحسن الذي أوتيه نبينا صلى الله عليه وسلم، فإنه بلغ الغاية ويوسف شطرها”.

“ ইবনু মুনীর এবং অন্যান্যরা এই হাদীসের ব্যাপারে বলেন: এখানে মর্মার্থ অনুধাবনে একটি বৈপরীত্য দেখা দেয় যে, সৌন্দর্যের বাকি অর্ধেক (ইউসুফ আলাইহিস  সালামকে অর্ধেক দেয়ার পর) সমস্ত মানুষেরা ভাগ করে নিয়েছেন। অথচ বিষয়টি এরকম নয়। বরং এর অর্থ হল, ইউসুফ আলাইহিস সালামকে সেই অর্ধেক পরিমাণ সৌন্দর্য দেয়া হয়েছে, যার পূর্ণাঙ্গ দেয়া হয়েছে আমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৌন্দর্যের মাপকাঠির পূর্ণতায় গিয়েছিলেন আর ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন তার অর্ধেকে।”(১০)
সুতরাং, হাদীসের ব্যাখ্যা থেকে এর মর্মার্থ এটিই বুঝা যায়, ‘ইউসুফ আলাইহিস সালাম সৌন্দর্যের অর্ধেক পাওয়া মানি এই নয় যে, সমস্ত সুন্দরের অর্ধেক দেওয়া হয়ে গেছে। আর বাকি অর্ধেক সকলকে ভাগ করে দিয়েছেন৷ যার ভিতরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও। বরং সৌন্দর্যের পরিমাণ বা বন্টনের হিসাব পূর্ণতার মাপকাঠির আলোকে হয়ে থাকে। আর ইউসুফ আলাইহিস সালামের লাভ করা সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য হল সৌন্দর্যের পূর্ণতার মাপকাঠির অর্ধেক। অন্যদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনুযায়ী পূর্ণতা পেয়েছিলেন।
 ★  হযরত ইসহাক্ব রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, তিনি বারা ইবনে আযিব রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছেন যে-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحْسَنَ النَّاسِ وَجْهًا، وَأَحْسَنَهُ خَلْقًا
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুন্দর  চেহারা এবং সুন্দর সৃষ্টির দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। (১১)
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমুহুল্লাহ এখানে দুইবার (أَحْسَن  দ্বারা উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘ফাতহুল বারি’-তে বলেন-
فإن فيه إشارة إلى الحسن الحسي، فيكون في الثاني إشارة إلى الحسن المعنوي
এখানে সবেচেয়ে সুন্দর দ্বারা প্রথম অংশে বুঝাচ্ছে ইন্দ্রীয় সৌন্দর্য তথা দেহের সৌন্দর্য। আর দ্বিতীয় অংশে সবচেয়ে মানবিক তথা সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বুঝানো হয়েছে।(১২)

★ আনাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীস আছে। তিনি বলেন-

أنه صلى الله عليه وسلم: كان أحسن الناس، وكان أجود الناس، وكان أشجع الناس

“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর মানুষ, সবচেয়ে দানশীল এবং সবচেয়ে সাহসী।” (১৩)

তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “তুহফাতুল আহওয়াযি”-তে আল্লামা মুবারকপুরি হাদীসের মর্মার্থ সম্পর্কে বলেন-

(أحسن الناس) خلقا وخلقا وسورة وسيرة ونسبا وحسبا ومعاشرة ومصاحبة

সৃষ্টিগত সৌন্দর্য, চারিত্রিক মাধুর্য, পদমর্যাদা, আদর্শ, বংশ, সম্মান, জীবনপ্রবাহ এবং বন্ধুত্ব– সর্বদিক দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। (১৪)

অতএব হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবিদের বক্তব্য এবং ইসলামি পণ্ডিতগণের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মর্যাদার দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ পাশাপাশি সৌন্দর্যের দিক দিয়েও সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
  ♦♦ সাহাবা কর্তৃক নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দৈহিক সৌন্দর্যের প্রসংশা:
ইসলামকে যারা সব থেকে বেশি বুঝেছেন, যারা সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করেছেন, তারা হলেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সঙ্গীসাথিরা। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিটি আদেশ-নিষেদ, পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতেন।  এমনকি সাধারণ বিষয়াবলীর মধ্যে যা অনুসরণ করা সম্ভব, সেগুলোরও অনুসরণ করতেন। সাহাবিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়কে প্রাণাধিক ভালবাসতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জীবনের প্রতিটি বিষয় খুজতেন এবং এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেন। ছোটো বা কম সংস্পর্শ পাওয়া সাহাবি এবং তাবেয়ীদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শারিরীক অবয়য়ের বর্ণনা করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা দৈহিক আকৃতিতে কেমন, কোন অংশ কিরকম ছিল, তা একটি একটি করে পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণনা করতেন আর এই অবয়বকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি দিতেন। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শারিরীক অবয়ব শরীয়তে আমলের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু তারা এমন করেছেন। তারা এই আলোচনা ও প্রশংসা করাকে খুব মহব্বত করতেন। আল্লাহই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তার পছন্দমতো সৌন্দর্য দিয়ে সুন্দরতম করেছেন। তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। আল্লাহ যে সুন্দর ও তিনি সুন্দরকে ভালবাসেন, এব্যাপারে  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
إن الله جميلٌ يحب الجمال

“আল্লাহ হলেন সুন্দর আর তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন।” (১৫)

মানুষের আদত হচ্ছে সে যা ভালবাসে তার আলোচনা বেশি বেশি করে।  এব্যাপারে একটি প্রসিদ্ধ হাদীস আছে, যা বহুলপ্রচলিত প্রবাদ হিসেবে ব্যবহৃত—
ﻣﻦ ﺃﺣﺐ ﺷﻴﺌﺎ ﺃﻛﺜﺮ ﻣﻦ ﺫﻛﺮﻩ

“কেউ যখন কোনো জিনিস ভালবাসে, সে তার আলোচনা বেশি করে।” (১৬)

সাহাবিরা এই পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। তারা প্রিয় নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের অনুসরণের পাশাপাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শামায়েল নিয়ে আলোচনা করতেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মুবারাকের  সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে প্রশংসা করতেন। নিম্নে সাহাবি কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শারীরিক অবয়বকে নিয়ে প্রসংশার কয়েকটি বর্ণনা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি।
★ হযরত ইসহাক্ব রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, তিনি বারা ইবনে আযিব রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব বলতে শুনেছেন যে-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحْسَنَ النَّاسِ وَجْهًا، وَأَحْسَنَهُمْ خُلُقًا، لَيْسَ بِالطَّوِيلِ الذَّاهِبِ، وَلَا بِالْقَصِيرِ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুশ্রী চেহারা এবং সুন্দর সৃষ্টি উভয় দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তিনি খুব বেশি লম্বা ছিলেন না বা খুব খাটো ছিলেন না। (১৭)
★ ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেওয়া সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনা কারি  সাহাবি আবূ হুরাইরা রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু বলেন-
مَا رَأَيْتُ شَيْئًا أَحْسَنَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَأَنَّ الشَّمْسَ تَجْرِي فِي وَجْهِهِ، وَمَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَسْرَعَ فِي مِشْيَتِهِ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَأَنَّمَا الْأَرْضُ تُطْوَى لَهُ، إِنَّا لَنُجْهِدُ أَنْفُسَنَا، وَإِنَّهُ لَغَيْرُ مُكْتَرِثٍ.
“ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাইতে বেশি সুন্দর কোনকিছুই  দেখিনি। মনে হত তাঁর চেহারায় সূর্য বিচরণ করছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র চেয়ে দ্রুত চলতেও অন্যকাউকে দেখিনি। যেন তাঁর জন্য যমিনকে গুটানো হত। তাঁর সাথে পথ চলতে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হত, আর তিনি অনায়াসে চলে যেতেন। (১৮) ★ হযরত আনাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু খেতমতে দশ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার প্রসংশা করে বলেন-
لاَ مَسِسْتُ خَزًّا قَطُّ وَلاَ حَرِيرًا وَلاَ شَيْئًا كَانَ أَلْيَنَ مِنْ كَفِّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ شَمَمْتُ مِسْكًا قَطُّ وَلاَ عِطْرًا كَانَ أَطْيَبَ مِنْ عَرَقِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ‏.‏
“আমি রেশম এবং পশম মিশিয়ে বানানো কাপড়ও নিজ হাতে ছুয়ে দেখেছি এবং খাঁটি রেশমী কাপড়ও ছুয়েছি কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতের চেয়ে অধিক নরম ও মসৃন কোন কিছু স্পর্শ করিনি। আমি মৃগনাভির ঘ্রাণ  গ্রহণ করেছি এবং আতরের ঘ্রাণও গ্রহণ করেছি, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শরীরের ঘামের চেয়ে অধিক সুঘ্রাণ কোনো কিছুতেই পাইনি।” (১৯)
★ জাবির ইবনে সামুরা রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণিমা চাঁদের থেকেও মোহনীয় বলেন-
رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي لَيْلَةٍ إِضْحِيَانٍ، وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ حَمْرَاءُ، فَجَعَلْتُ أَنْظُرُ إِلَيْهِ وَإِلَى الْقَمَرِ، فَلَهُوَ عِنْدِي أَحْسَنُ مِنَ الْقَمَرِ
“আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তাঁর দিকে ও একবার চাঁদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হলো তিনি আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে অধিকতর চমৎকার।”(২০)
★ কাব ইবনু মালিক রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু খুশির সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্যের ব্যাপারে বলেন-
لَمَّا سَلَّمْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ يَبْرُقُ وَجْهُهُ مِنَ السُّرُورِ، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا سُرَّ اسْتَنَارَ وَجْهُهُ، حَتَّى كَأَنَّهُ قِطْعَةُ قَمَرٍ، وَكُنَّا نَعْرِفُ ذَلِكَ مِنْهُ‏.‏
“আমি যখন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে সালাম করলাম, খুশী ও আনন্দে তাঁর চেহারা ঝলমল করে উঠলো। তাঁর চেহারা এমনিই আনন্দের সময় আলোয় টগবগ করত। মনে হত যেন চাঁদের খণ্ডিত টুকরো। মুখমণ্ডলের এ অবস্থা দেখে আমরা তার আনন্দের কথা বুঝতে পারতাম।”(২১)
★ জাবির রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শামায়েল বর্ণনা করছিলেন। এমন সময় একজন প্রশ্ন করলো-
أكان وجه النبي صلى الله عليه وسلم مثل السيف؟ قال: لا، كان مثل الشمس والقمر، وكان مستديرا
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার চেহারা কি তরবারির ন্যায় ছিল? জাবের রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু বলেন- না, বরং চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় (উভয়টির মিশ্রিত উজ্জ্বল) ছিলেন এবং তাঁর চেহারা গোলাকার ছিল।” (২২)
★ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সভা কবি, শায়িরুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসান ইবনে সাবিত রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু কবিতার ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমার দৈহিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রসংশা করে বলেন-
وَأَحسَنُ مِنكَ لَم تَرَ قَطُّ عَيني
وَأَجمَلُ مِنكَ لَم تَلِدِ النِساءُ
خُلِقتَ مُبَرَّءً مِن كُلِّ عَيبٍ
كَأَنَّكَ قَد خُلِقتَ كَما تَشاءُ

“মোর চোখ আপনার চেয়ে সুন্দর দেখে নাই কোনো কিছু
কোনো মা জন্ম দেয় নি আপনার চেয়ে সুশ্রী কোনো শিশু,

আপনাকে বানানো হয়েছে নিষ্পাপ আর ক্রুটিমুক্ত করে
যেন আপনি যেমন চেয়েছিলেন আপনার মাবুদের দ্বারে।” (২৩)

★ আমাদের জান্নাতের সরদার হাসান ইবনে আলী রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত শামায়েল সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ একটি  হাদীস রয়েছে।  হাদীসে  দেখা যায় সাহাবিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শারীরিক অবয়বের বর্ণনা করাকে ভালোবাসতেন এবং তারা যে এই সম্পর্কে জ্ঞাতদের কাছ থেকে জেনে নিতেন, এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়। পাশাপাশি তারা যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দেহের সাথে নিজেদের সাদৃশ্য হওয়ার আকাঙ্কা করতেন, তাদের এই কামনাটিও প্রকাশ পায়। যেমন, তিনি বলেন-
سَأَلْتُ خَالِي هِنْدَ بْنَ أَبِي هَالَةَ ، وَكَانَ وَصَّافًا عَنْ حِلْيَةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَأَنَا أَشْتَهِي أَنْ يَصِفَ لِي مِنْهَا شَيْئًا ، فَقَالَ : ” كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , فَخْمًا مُفَخَّمًا ، يَتَلأْلأُ وَجْهُهُ تَلأْلُؤَ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ
“আমি আমার মামা হিন্দ ইবনে আবি হালা রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার অবস্থা জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বর্ণনা করতেন। তখন আমি কামনা করছিলাম যে, তাঁর বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহের সাথে আমারও যেন কোনো অংশ মিলে যায়। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহাকৃতি ছিল সমুন্নত  ও মর্যাদাসম্পন্ন। তাঁর চেহারায় পূর্ণিমা রাতের চাঁদের ন্যায় আলো জ্বলজ্বল করত। (২৪)
 পরিশেষে বলি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং সবচেয়ে সৌন্দর্যের অধিকারী করে বানিয়েছেন। আমাদের জন্য আবশ্যক আমাদের নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শরীয়ত পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রাণাধিক ভালবাসা। আর আমাদের এই ভালোবাসার আলামত হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জীবন পাঠ জানা। পাশাপাশি উচিত সাহাবিদের মত  তাঁর দেহ মুবারাক সম্পর্কেও জানা, আলোচনা করা।  এটা হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি চুড়ান্ত ভালবাসা আর আনুগত্যের অন্যতম এক নিদর্শন।
সতর্কতা:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আলোচনার সময় আমাদেরকে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভাষাগত দিকের পাশাপাশি অন্তরেও সম্মান প্রদর্শন করা আল্লাহর আদেশ। আল্লাহ আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাধারণ মানুষের মত সম্বোধন করতে নিষেধ করে বলেন—
لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا

‘তোমরা পরস্পরকে যেভাবে সম্বোধন করো, রাসূলকে সেভাবে সম্বোধন করো না ।’ (২৫)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আলোচনায় সতর্কতা ও সম্বোধন নিয়ে বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে। অনেক কথা ও বিষয় আমাদের ক্ষেত্রে সাধারণ হলেও, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা উলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে গালির নামান্তর। এব্যাপারে সর্বজনস্বীকৃত সালাফ, বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ আল্লামা কাদ্বি ইয়াদ্ব রাহিমাহুল্লাহ এর প্রদানকৃত মূলনীতি হল—
اعْلَمْ وَفَّقَنَا اللَّهُ وَإِيَّاكَ أَنَّ جَمِيعَ مَنْ سَبَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْ عَابَهُ أَوْ أَلْحَقَ بِهِ نَقْصًا فِي نَفْسِهِ أَوْ نَسَبِهِ، أَوْ دِينِهِ أَوْ خَصْلَةٍ مِنْ خِصَالِهِ أَوْ عَرَّضَ بِهِ أَوْ شَبَّهَهُ بِشَيْءٍ عَلَى طَرِيقِ السَّبِّ لَهُ أَوِ الْإِزْرَاءِ عَلَيْهِ، أَوِ التَّصْغِيرِ لِشَأْنِهِ، أَوِ الْغَضِّ مِنْهُ وَالْعَيْبِ لَهُ فَهُوَ سَابٌّ لَهُ.
وَالْحُكْمُ فِيهِ حُكْمُ السَّابِّ يُقْتَلُ كَمَا نُبَيِّنُهُ.
জেনে রাখো এবং আল্লাহ যেন তা থেকে আমাদের বেঁচে থাকার তাওফীক দেন—যে ব্যাক্তি নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিল বা দোষী বানালো; তাঁর নিজ সত্তা, বংশ, দীনদারি অথবা স্বভাবের দোষ খুজল বা ক্রটির আলোচনা করল; তাঁকে এমন কিছুর সাথে সাদৃশ্য দিল যা গালির দিকে যায় বা অবজ্ঞা করা হয়; তাঁর মর্যাদাকে কমানো বা এব্যাপারে অসন্তুষ্ট মনোভাব রাখা, তাঁর দোষ বের করা—সবই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালির নামান্তর। আর এসবের শরঈ হুকুম হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালিদাতার ন্যায় তাকে ফাঁসি দেওয়া।

পরবর্তীতে আরও বলেন–

وَكَذَلِكَ مَنْ لَعَنَهُ أَوْ دَعَا عَلَيْهِ، أَوْ تَمَنَّى مَضَرَّةً لَهُ، أَوْ نَسَبَ إِلَيْهِ مَا لَا يَلِيقُ بِمَنْصِبِهِ عَلَى طَرِيقِ الذَّمِّ، أَوْ عَبَثَ فِي جِهَتِهِ الْعَزِيزَةِ بِسُخْفٍ مِنَ الْكَلَامِ، وَهَجْرٍ ومنكر من القول وزور. أو عَيَّرَهُ بِشَيْءٍ مِمَّا جَرَى مِنَ الْبَلَاءِ وَالْمِحْنَةِ عَلَيْهِ، أَوْ غَمَصَهُ بِبَعْضِ الْعَوَارِضِ الْبَشَرِيَّةِ الْجَائِزَةِ  وَالْمَعْهُودَةِ لَدَيْهِ، وَهَذَا كُلُّهُ إِجْمَاعٌ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَأَئِمَّةِ الْفَتْوَى مِنْ لَدُنِ الصَّحَابَةِ رِضْوَانُ اللَّهِ عليهم إلى هلم جرا
এমনিভাবে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লা’নত করল বা এর দিকে আহবান করল, তাঁর জন্য অসম্মানজনক কিছু চাইলো, নিন্দার্থে শানের খেলাফ কিছুর দিকে সম্পৃক্ত করল, কথারছলে তাঁর কোনো কিছু নিয়ে নির্বোধের মত খেলা করল, মন্দ বা খারাপ কথা বলল বা অসম্মান করল, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো পরীক্ষা বা দয়ার ব্যাপারে তিরস্কার করল, তাঁর মানবীয় অঙ্গের কোনোটিকে অপূর্ণাঙ্গ বলল—এইসব ব্যাপারে সাহাবি রিদ্বওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাইনের যুগ থেকে উলামায়ে কিরাম ও ফতোয়া দানকারীগণের নিকট ইজমা হয়েছে যে, এগুলো সব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি হিসেবে সাব্যস্ত (মা‘য়াযাল্লাহ)।’(২৬)
আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিপূর্ণ অনুসরণ এবং তাঁর হক যথাযতভাবে আদায় করার তাওফীক দান করেন। আমীন!

————————————
ফুটনোট:
(১) সুরা ত্বীন : ০৪
(২) ইমাম তাবারানি রাহ. (৩৬০ হি.), আত তাফসীরুল কাবীর, সুরা তীন- ০৪
(৩) ইমাম মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ (২৭৫ হি.), সহীহ মুসলিম, কিতাবু ঈমান, বাবু ইসরা বির রাসূল, হাদীস নং- ১৬২
(৪) সুরা আল হুজুরাত: ১৩
(৫) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ (২৪৩ হি.), আল মুসনাদ, হাদীস ২৩৪৮৯
(৬) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা আত তিরমিযি (২৭৯ হি.),  শামায়েল তিরমিযি, হাদীস নং- ২৪৫
(৭) ইমাম মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ (২৭৫ হি.), সহীহ মুসলিম, কিতাবু ঈমান, বাবু ইসরা বির রাসূল, হাদীস নং- ১৬২
(৮) আল্লামা আবুল ফারজ ইবনুল জাওযি রাহিমাহুল্লাহ (৫৯৭ হি.), কাশফুল মুশকিল মিন হাদীসিস সাহীহাইন, দারুল ওয়াত্বন, রিয়াদ্ব, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭ ঈসায়ি, ৩/ ২১৩ পৃষ্ঠা
(৯) আল্লামা আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু কায়্যিম আল জাওযি (৭৫১ হি.), বাদাইউল ফাওয়াইদ, দারু ইলমিল ফাওয়াইদ, ৩/১১৬৬-১১৬৭
(১০) আল্লামা যারকানি রাহিমাহুল্লাহ, শারহুল আল্লামা আয যারকানি আলা মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা বি-মানহিল মুহাম্মাদিয়্যাহ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, লেবানন,  প্রথম প্রকাশ ৫/২৪০ পৃষ্ঠা
(১১) ইমাম বুখারি (২৫৬ হি.), সাহীহ বুখারি, কিতাবুল মানাকিব, বাবু সিফাতিন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদীস নিং- ৩৫৪৯
(১২) আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানি (৮৫২হি.), ফাতহুল বারি শারহু সাহীহিল বুখারি, কিতাবুল মানাকিব আনসার, বাবু সিফাতিন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদীস নং ৩৫৪৯
(১৩) ইমাম বুখারি, সহীহুল বুখারি, কিতাবুল জিহাদি ওয়াস সিয়ার, বাবুশ শুজায়াতি ফিল হারবি ওয়াল জুবন, হাদীস নং- ২৮২০
(১৪) আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরি, তুহফাতুল আহওয়াযি বি-শারহি জামিয়িত তিরমিযি, আবওয়াবুল জিহাদ আন রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, বাবুল খুরুজ ইনদাল ফাযায়ি, হাদীস নং- ১৬৮৭
(১৫) ইমাম মুসলিম, সাহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাবু তাহরীমিল কিবরি ওয়া বাইয়ানিহি, হাদীস নং ৯১
(১৬) ইমাম বুখারি, সাহীব বুখারি, কিতাবুল মানাকিব, বাবু সিফাতিন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদীস নিং- ৩৫৪৯
(১৭) আল্লামা জালালুদ্দীন সিয়ুতি (৯১১ হি.), আল জামিউস সাগীর, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, লেবানন, ষষ্ঠ প্রকাশ, হাদীস নং- ৮৩১২] (১৮)  ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (২৪১ হি.), মুসনাদে আহমাদ, আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহুর মুসনাদ,হাদীস নং ৮৯৪৩; ইমাম তিরমিযি ২৭৯ হি.,
জামেউত তিরমিযি, আবওয়াবুল মানাকিব আন রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদিস নং ৩৬৪৮
(১৯) ইমাম তিরমিযি, সুনানুত তিরমিযি, আবওয়াবুল বিররি ওয়াসসিলাতি আন রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, বাবু মা জায়া ফি খুলুকিন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদীস নং ২০১৫
(২০) ইমাম তিরমিযি, শামায়েলে মুহাম্মাদিয়া, হাদীস নং ৭
(২১) ইমাম বুখারি, সহিহ বুখারী, কিতাবুল মানাকিব,  বাবু সিফাতিন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদিস নং ৩৫৫৬
(২২) ইমাম মুসলিম, সাহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফাদ্বাইল, বাবু শাইবিহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদীস নং- ২৩৪৪
(২৩) দিওয়ানু হাসসান ইবনে সাবিত রা., দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, লেবানন, তৃতীয় প্রকাশ ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ২১
(২৪) ইমাম তিরমিযি, শামায়েলে মুহাম্মাদিয়া, হাদীস নং- ২৫৮
(২৫) আল কুরআন,  সুরা আন-নূর ৬৩
(২৬) আল্লামা কাদ্বি ইয়াদ্ব ইবনু মুসা ইবনে ইয়াদ্ব রাহিমাহুল্লাহ (৫৪৪ হি.), আশ শিফা বি-তারীফি হুক্বুকিল মুস্তাফা, দারুল ফাইহা, আম্মান, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৪০৭ হি., ২/৪৭৩-৪

লিখেছেন: ইমাদ উদ্দিন।
Rate this post