ফুরফুরা পীর সাহেব হযরত আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ)-এর দ্বীনের দাওয়াত

বংশ পরিচয়ঃ-

ইসলামের প্রথম খলিফা আমীরুল মুমেনীন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিম্নতম চৌদ্দ দশ বংশধর হযরত মাওলানা জিয়াউদ্দিন জাহেদ (রহঃ) ইসলাম প্রচার মানসে আরবদেশ থেকে ভারতে এসে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর পুত্র হযরত মনসুর বাগদাদী (রহঃ) তখন বাগদাদে অবস্থান করছিলেন। ভারত সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর রাজত্বকালে ৭৪১ হিজরী মুতাবিক ১৩৪০ সনে হযরত মনসুর বাগদাদী (রহঃ) বঙ্গদেশে হুগলী জেলার মোল্লাপাড়া গ্রামে বাসস্থান নির্মাণ করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তার নিম্নতম অষ্টম পুরুষ কুতুবুল আকতাব হযরত মাওলানা মুস্তাফা মাদানী যুগ শ্রেষ্ঠ বুর্জুগ ও কামেল অলী ছিলেন। তিনি অসাধারণ রুহানী শক্তির বলে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, “আমার ষষ্ঠ পুরুষের পর এমন একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করবে যে, উচ্চস্তরের ওলী হবে। যখন সারা বাংলা-আসাম শিরক-বিদআতে নিমগ্ন হয়ে পড়বে, তখন ঐ পুত্রের দ্বারা সকল প্রকার কুসংস্কার দূরীভূত হবে। সারা ভারত এমনকি আরব পর্যন্ত তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।” বলাবাহুল্য, মুজাদ্দেদে জামান হযরত মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ)-ই হলেন সেই ভবিষ্যদ্বাণীর শিরক-বিদআত চূর্ণকারী ধর্মপ্রচারক ও সমাজ সংস্কারক।

জন্মঃ-

হযরত মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ) ১৮৪৬ খ্রী. ১২৫২ বঙ্গাব্দে হুগলী জেলার ফুরফুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে বাংলা ১২৫৩ সন আবার কারো মতে ১২৬৫ বঙ্গাব্দ। পিতাঃ- আলহাজ মাওলানা আবদুল মোকতাদির। মাতাঃ- মহাব্বাতুন্নেছা। মরহুমা খুবই দীনদার ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে উন্নত ছিলেন। হযরত মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ) ছিলেন পিতামাতার একমাত্র সন্তান। নয় মাস বয়সে তার পিতৃ বিয়োগ হয়।

শিক্ষাঃ-

গ্রামের মক্তবে শিক্ষা শেষ করে তিনি ফুরফুরা সন্নিহিত সীতাপুর মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। তারপর হুগলী মুহসিনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সকল পরীক্ষাতেই উচ্চস্থান অধিকার করে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তৎকালীন সর্বোচ্চ ক্লাস ‘জামাতে উলা’ কৃতিত্বের সাথে পাস করেন।
মানতেক ও দর্শন শাস্ত্রের উচ্চমানের গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেন দর্শন শাস্ত্রে বিজ্ঞ পণ্ডিত আল্লামা হযরত নজর শাহ বেলায়তীর নিকট। বোখারী শরীফ সহ হাদীস ও তফসীরের গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেন সৈয়দ আহমদ এরফান শহীদ (রঃ)-এর খলিফা প্রখ্যাত মোহাদ্দেস আহমদ আলী সাহারান পুরী (রঃ)-এর বিশিষ্ট ছাত্র ও শিষ্য মুহাদ্দিস হাফেজ জামালউদ্দিন মুঙ্গেরীর নিকট। ২৩-২৪ বৎসর বয়সে তিনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তারপর তিনি মক্কা ও মদীনায় গমন করে রওজা শরীফের খাদিম বিখ্যাত আলিম আদ-দালাইল আমীন রিদওয়ান-এর নিকট হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং তার নিকট থেকে ৪০টি হাদীস গ্রন্থের সনদ (সার্টিফিকেট) লাভ করেন। এরপরেও তিনি সুদীর্ঘ আঠারো বছর একাধারে হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ অধ্যয়ন ও গবেষণা করে ইল্ম দ্বীন সম্পর্কে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন

তরিকত শিক্ষাঃ-

পাঠ্যাবস্থাতেই ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল । কি যেন এক অজানা জ্ঞান আহরণের জন্য তার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তিনি আঁধার রাতে বিভিন্ন সুফীদের কবরের পাশে গিয়ে কবরের কথা মনে করে কেঁদে ভাসাতেন। কি যেন এক কৌতূহল তাঁকে তন্ময় করে ফেলত। অগাধ বিদ্যার অধিকারী হলেও তাই তিনি ইলম মারেফাতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তিনি সর্বদা জিকির আজকার, মুরাকাবা-মুশাহিদা ও কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি পাঠ্যাবস্থাতেই স্বপ্নযোগে নবী করীম (সাঃ), হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর কাছে কিছু দ্বীনি মাছআলা এবং বাতিনী ফয়েজ লাভ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি উপলব্ধি করছিলেন যে, মানুষের মধ্যে পশু আর ফেরেশতা স্বভাব আছে। পশু স্বভাবে বশীভূত হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, তখন সে পশুর চেয়েও অধম হয়। তাই তিনি পশু স্বভাবের বিরুদ্ধে কঠোর সংযম শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে ফিরিশতা স্বভাবের বৃত্তিগুলোকে প্রকাশ করতে শরিয়ত মতে চেষ্টাবান হন। তিনি রিয়াজাত ও মুজাহিদয়ে আত্মনিয়োগ করেন। দীর্ঘদিন এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর নফসে আম্মারা সংযত হয়। সঙ্গে সঙ্গে ফিরিশতা স্বভাবের বৃত্তিগুলো সতেজ হয়ে উঠে আধ্যাত্মিক আলো বিকাশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। ঠিক এই সময়ে এক শুভ মুহূর্তে তিনি সান্নিধ্য লাভ করলেন সমকালীন সাধক শ্রেষ্ঠ শাহ সুফী ফাতেহ আলী ওয়াইসী (রঃ)-এর। তাঁর কাছে মুরীদ হয়ে তিনি ইলম মারেফাত বা তরিকত শিক্ষা করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে ফানা ফি-শায়খের স্তরে উপনীত হন। পীর তাঁকে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবান্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া তরিকার তা’লিম দিয়ে ‘খিলাফত’ দান করেন।

দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগঃ-

পীর আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ) কিতাবী ও আধ্যাত্মিক (শরীয়ত ও মা’রেফাত) বিদ্যায় পারদর্শিতা হাসিল করে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করেন। বাংলা ও আসামের শহরে, গ্রাম-গঞ্জে তিনি বহু ধর্মসভায় দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। কি করে, কেমনভাবে আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসুলকে সন্তুষ্ট। করা যায় তা তাদের মহব্বত অন্তরে সৃষ্টি করা যায়, তা তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করতেন। সংস্কারমূলক দ্বীন ইসলাম ও স্বাধীনতা। গাছের জন্য তিনি জনসাধারণকে কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রেরণা দান করে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। তাঁর উপদেশে কত মুশরিক, বেদআতী শিরক-বিদআত পরিত্যাগ করেছে, কত লক্ষ বে-নামাজী, বে-রোজাদার নামায-রোযা শুরু করেছে, বে-দাড়ীওয়ালা দাড়ী রাখতে অভ্যস্ত হয়েছে, কত অনৈসলামী পোশাকধারী ইসলামী পোশাক পরিধান করতে শিখেছে, কত সুদখোর ঘুষখোর, হারামখোর সুদ-ঘুষ হারামখুরী ত্যাগ করেছে, কত শহর ও গ্রামে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ও ইয়াতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ইয়ত্তা করা সম্ভব নয়। তাঁর সংস্কারমূলক বক্তৃতায় মানুষ পূজা, পীর-পূজা, কবরপূজা,দরগাপূজা, পীর-সিজদা ইত্যাদি বেশরিয়তী কাজের মূলে কুঠরাঘাত করেছিল।

শরীয়তী ইসলাম এদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করার উদ্দেশ্যে তিনি বহু স্থানে বিরাট ওয়াজ মাহফিল ও তালিম গাহ্ প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মাহফিলগুলো ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ফুরফুরায় তার নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ওয়াজ-মাহফিলের উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে তিনি অসিয়ত করে গেছেন।

মুজাদ্দেদে জামান হযরত আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ)-এর আক্বীদা (বিশ্বাস) ছিল ইলম তাসাওউফ বা ইলমে বাতিন। যাতে মুক্তির প্রধান পথ আল্লাহ তায়ালার সন্ধান, রিপু বিনাশ ও সংযম শিক্ষা রয়েছে, তা শিক্ষা করা ফরয, যার অন্তঃকরণ আল্লাহ প্রেমের আকর্ষণে, আধ্যাত্মিক-জ্ঞানে ও আত্মার জন্মগত পবিত্রতা দ্বারা পরিশুদ্ধ হয় নি। আর উক্ত গুণসমূহ অধিকাংশ লোকের মধ্যেই দুষ্প্রাপ্য। পক্ষান্তরে শরীয়তের হুকুম সংখ্যাধিক্যের উপরই প্রযুক্ত হয়ে থাকে। বিশেষত ইলম জাহের (শরীয়তী শিক্ষা) দ্বারা আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা কার্য সমাধা হয় না। উক্ত মত চার মাযহাবের ইমামগণ এবং মুসলিম জগতের মনীষীগণ ইলম জাহের শিক্ষা করার পর ইলম বাতিন বা ইলম মা’রেফাত শিক্ষা করা ফরয বলে সমর্থন করে গেছেন। শুধু তাই নয়, বরং শরীয়তের বাহ্যিক জ্ঞান লাভ করার পরে তারা ইলম মা’রেফাত শিক্ষার উদ্দেশ্যে মা’রেফাতপন্থী আলিমগণের সংসর্গ, খেদমতে, পথে, পবিত্র বিশ্বাসে, সরলতায় কু-অভ্যাস বর্জনে ও সদগুণ অনুশীলনে নিরত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শরীয়ত যথার্থরূপে প্রতিপালন করতে না পারলে মা’রেফাত লাভ হয় না, সেরূপ মা’রেফাত শিক্ষা না করলে শরীয়ত যথার্থরূপে আদায় হয় না, উভয়কে সংরক্ষণের জন্য উভয়ের দরকার। এরূপ শিক্ষা লাভ করা তাসাওউফবিদ ও তাঁর অনুসরণকারী উন্মুক্ত পীরের সোহবাত বা সংসর্গ ও তালীম ছাড়া অনুসরণকারী উন্মুক্ত পীরের সোহবাত বা সংসর্গ ও তালীম ছাড়া সম্ভব নয়।

অন্তঃকরণের দোষ-ত্রুটি দূর করতে হলে প্রথম পীরে কামেলের কাছ থেকে অন্তর পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অন্তরে সদগুণরাজি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, বাতিনী ইলমের পদ্ধতিগুলো একের পর এক শিক্ষা লাভ করতে হবে। কারণ, অন্তর পরিষ্কার হলে জাহিরী ইবাদত-বন্দেগীতে সুফল প্রকাশ পাবে। এ পথের পথিক হতে হলে পীরের আদেশ অনুযায়ী বাতিনী ইলমের পদ্ধতিগুলো যেমন কাদিরীয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও মুজাদ্দেদীয়া ইত্যাদি সিলেবাস বা পাঠ্যতালিকার ন্যায় মনে করে আমল করতে হবে,যেমন জাহিরী বিদ্যার পাঠ্যতালিকা যা নবী করীম (সাঃ)-এর সময় ছিল না সেইরূপ বাতিনী ইলমের পাঠ্যতালিকাকে মনে করতে হবে। বর্তমান বিবিধ রকম ফিতনা-ফাসাদের যুগে কুরআন- হাদীস পাঠ করে নিজে নিজে বাতিনী ইলম আয়ত্ত করা যায় না বা অভ্যন্তরীণ দোষ-ত্রুটি দূর করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন উস্তাদ বা পীর বা শায়খের। এজন্যই ফুরফুরার পীর সাহেব (রহঃ) আধ্যাত্মিক জ্ঞান হাসিলের জন্য এবং অন্তরের পবিত্রতা অর্জনের জন্য পীরের কাছে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন এবং অপরকেও বায়আত গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি একজন কামেল পীর ছিলেন। বাংলা আসামের প্রতিটি এলাকায় তিনি যেখানে সফর করেছেন, সেখানে শতশত লোক তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেছে। তিনি বিভিন্ন স্থানে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ খানকাহর মাধ্যমে জিকর-আজকার ও ইলম মারেফাতের তা’লিম দিতেন। তিনি অনেককে খিলাফতি দান করেছেন। তারাও বিভিন্ন স্থানে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদেরকে মুরীদ করেছেন এবং আত্মশুদ্ধির জন্য খাস তালিম দিয়েছেন।

তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের কথা এই নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব হল না। তিনি সমাজ ও সরকারের শরীয়ত বিরোধী কাজের প্রতিবাদ করে খাঁটি তাবলীগী দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বাইরেও তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিতে ত্রুটি করেন নি। ফুরফুরার পীর সাহেব দুনিয়াতে আর নেই, তবুও ভারত ও বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজও ফুরফুরার পীর সাহেবের ভক্ত ও মুরীদ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। এই মহান ব্যক্তি ১৯৩৯ খ্রীঃ ১৭ই মার্চ (৩রা চৈত্র ১৩৪৫ ব.) শুক্রবার ভোরে ইন্তেকাল করেন।

লিখেছেন:-
সেখ সিয়াম আহমাদ
শিক্ষার্থী, গাবাটি এ, এইচ, এম সিনিয়র মাদ্রাসা

1/5 - (1 vote)