বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী; একটি উদারনৈতিক, জ্ঞান ও বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ গঠন।

প্রায় ৬৩৬ বছর মুসলিমদের দ্বারা শাসিত উসমানী/তুর্কি খিলাফতের অন্তর্গত পূর্ব আনাতোলিয়ার বিৎলিস প্রদেশের নুরস নামক এক কুর্দি গ্রামে ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মির্জা আফিন্দী আর মাতা নুরিয়া হানিমের সাত সন্তানের মাঝে সাঈদ ছিলেন চতুর্থ। জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখায় মোল্লা ফাত্হুল্লাহ আফিন্দী নামক তৎকালীন এক বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব তাঁকে ‘বদিউজ্জামান’ বা ‘যুগের বিস্ময়’ নামে অভিহিত করেন। আর তখন থেকেই তিনি ‘বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

নয়/দশ বছর বয়স থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। দর্শন, ধর্মতত্ত¡সহ বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। মোল্লা আমীন আফিন্দী, মাদ্রাসা, মীর হাসান ওয়ালী মাদ্রাসা বায়েজীদ মাদ্রাসাসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর প্রখর ধীশক্তি আর যুক্তিপূর্ণ কথা তৎকালীন পন্ডিন্ডদের যেমন অভিভূত করেছে তেমনি সাধারণ মানুষকে এক নতুন জীবনবোধের সন্ধান দিয়েছে।
 
সাঈদ নুরসী তুরষ্কে একটি উদারনৈতিক, জ্ঞান ও বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নিজের বিশ্বাসের মাঝেই স্বাধীনতা নিহিত। আর মূর্খতার বিরুদ্ধে জ্ঞান দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। দারিদ্রতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় শিল্প ও নৈপূন্য দিয়ে। বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হয় ঐক্য ও সংহতি দিয়ে। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে মাদ্রাসাতুয যাহরা নামে একটি মডেল মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বাসের আলোকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে রিসালা-ই-নূর রচনা করেন, যা প্রায় ছয় হাজার পৃষ্ঠারও অধিক। তিনি যেখানেই যেতেন সাধারণ মানুষ তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়তো। ফলে তারাই রিসালা-ই-নূর’কে তুরষ্কের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে কাজ করেন। ইতোমধ্যে পৃথিবী বিভিন্ন ভাষায় তা অনুদিত হয়েছে।
 
বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী’র দীর্ঘ সংগ্রামের ফলস্বরূপ আজকের তুরষ্ক। একজন আত্মত্যাগী, সংগ্রামী আর ভিশনারী সাঈদ নুরসী’র আধ্যাত্মিক প্রভাব তুরষ্কের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ে আজও অনুরণিত হচ্ছে।
 
নুরসী রহ এর সংস্কারের সময়টা মূলত কামাল পাশা আতাতুর্কের সময়ে। ১৯২৩-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত আতাতুর্ক তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। দুনিয়ার জঘন্য মুসলিম শাষকদের মধ্যে একজন হলেন কামাল পাশা।
 
পাশা চিন্তা চেতনায় ছিল, মুসলিমদের অধপতনের কারন হচ্ছে সব কিছুতে ধর্ম ধর্ম করা। এবং কট্টর ভাবে ইসলাম মানার পক্ষে থাকা। এভাবে থাকলে ইউরোপীয়দের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত জাতি হওয়া সম্ভব না। অতএব, ধর্ম থাকবে থাকুক কিন্তু এতে পরিবর্তন আনতে হবে।
 
পাশা নিজস্ব যেসব নীতিমালা প্রণয়ন করলেন তার কিছু-
 
ক) টুপি পাঞ্জাবী পরা যাবে না, ইউরোপিয়ান দের মত কোর্ট হ্যাট পরতে হবে। দাড়ি রাখা যাবে না, বোরকা পরা যাবে না।
খ) টার্কিশ লিখা আর আরবী হরফে চলবে না, ল্যাটিন ইংলিশে লিখতে হবে।
গ) সব মসজিদে আজান দেয়া যাবে না। যেসব মসজিদে দেয়া যাবে সেসবে আরবীতে নয়, তুর্কী ভাষায় আজান দিতে হবে।
ঘ) এত মাদ্রাসার কোনো কাজ নেই। শিক্ষা ব্যাবস্থায় ইউরোপীয়দের অনুসরন করতে হবে।
ঙ) ভাল মসজিদ গুলোকে গুদাম ঘর, যাদু ঘরে পরিণত করা হয়। এবং বাকি গুলোতে গরু ছাগল ভেড়া পালন করা হতো।
চ) শত শত কুরআন হাফেজ, আলেম, তালেবুল ইলমকে হত্যা করা হয়।
আরো বহু রকমের অন্যায় অত্যাচার জুল্ম করেছে যার বর্ণনা অল্প বিস্তরে দেয়া সম্ভব নয়।
 
সাঈদ নুরসীকে কামাল পাশা পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ করলেন। নুরসী রহ গিয়ে দেখলেন, দীনের অন্য বিষয় আর কী থাকবে পার্লামেন্টের এমপি মন্ত্রীরা তো নামাজই পড়ে না। তিনি নামাজের উপর লেকচার দিলেন শুরুতেই। এরপর পাশা বলল, আমরা চাই ঐক্য বজায় চলতে। এখন দেখা যাচ্ছে কেউ নামাজ পড়ে কেউ পড়ে না। পার্লামেন্টে অনৈক্য বিরাজ করছে ইত্যাদি।
 
যাইহোক জালেম সরকারের সামনে সত্য উপস্থাপনের সুন্নাত পদ্ধতিতে নুরসী এগুলেন। এদিকে পাশাও তার কাজ চালিয়ে গেলেন। নুরসীর উপর অত্যাচার শুরু। জনগণের রোষে পড়ার ভয়ে মেরেও ফেলতে পারছেন না। কখনো জেলে, কখনো নির্বাসনে এভাবেই কাটছে সাইয়েদ নুরসী রাহিমাহুল্লার জীবন। উল্লেখ্য, উনার জীবনের শেষের ত্রিশটি বছর এভাবেই কেটেছে।
 
 
সে সময় আরেকজন আলেম ছিলে সাইয়েদ কুরদী। তিনি পাশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ আন্দোলন শুরু করলেন। নুরসি রহ. কে প্রস্তাব দিলেন, এভাবে আর কত সহ্য করা হবে? এবার তো আন্দোলন ডাকতে হয়। পাশার বিরুদ্ধে জিহাদ না করে উপায় নেই। উনার যুদ্ধে নুরসী রাহিমাহুল্লাহকে একত্রিত হওয়ার আহবান জানালেন। কারন, নুরসীর অনেক জন সমর্থন আছে।
 
কিন্তু নুরসী রাহিমাহুল্লাহ এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। এত এত কিছুর পরেও পাশাকে কাফের ফতোয়া দিলেন না। উল্টো প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে বললেন, “মুসলিম শাষকের বিরুদ্ধে কোন জিহাদ নেই। জিহাদ হবে মুসলিম শাষককে ঢাল করে কাফেরের বিরুদ্ধে। শাষক যতই অন্যায় অত্যাচার করুক সবর করতে হবে, দাওয়াতের মাধ্যমেই পরিবর্তন আসে। আমাদের কাজ ঈমান সংরক্ষণ করা যুদ্ধ হানাহানি নয়।” নুরসী রহ. কুরদী রহ. এর সাথে যোগ দিলেন না৷
 
এদিকে কুরদী রহ. এর মুজাহিদ বাহিনীকে কামাল পাশা হত্যা করছে, জেলে ঢুকাচ্ছে, অত্যাচার করছে। স্বাভাবিক ভাবে ক্ষমতা রক্ষার্থে শাষক যা করে তাই করছে। আর অন্যদিকে, নুরসী রাহিমাহুল্লাহ জনগণকে বুঝাচ্ছেন। আর ঈমান আকিদা সম্পর্কে প্রচুর লিখালিখি করে যাচ্ছেন। এক কথায় নিরবিচ্ছিন্ন দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন। কুরদীর যুদ্ধে সাড়া না দিয়েও, যুদ্ধের বিচারে পাশা নুরসী রাহিমাহুল্লাহকে নির্বাসনেও পাঠিয়ে দিলেন।
 
পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নুরসী রাহিমাহুল্লার দাওয়াতের বিপ্লবী ফল আসতে শুরু করে। কিন্তু যারা অতিদ্রুত সব সমাধান করার লক্ষ্যে পাশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, অবর্ণনীয় অত্যাচারিত হয়েছে, প্রাণহানি হয়েছে কিন্তু সেভাবে ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি।
 
আল্লাহ নুরসী রাহিমাহুল্লার প্রতি রহম করুন। এটাই সুন্নাহ, এটাই সালফে সালেহীনের মানহাজ। পরিবর্তন আসে দাওয়াতের মাধ্যমে, সংশোধনের মাধ্যমে। জিহাদের নামে সন্ত্রাস শুধু বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করে, মুসলিম উম্মাহর আরো বিপদের কারণ হয়।
 
মুসলিম উম্মাহর দুঃখ দুর্দশায় মুমিনের অন্তর ব্যাথিত হবে, পরিবর্তনের চেষ্টা করবে, দুয়া করবে। কিন্তু সালফে সালেহীনের মানহাজ অনুসরণ না করে দাংগা হাংগামার মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করা কখনোই কাম্য নয়।
বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর জীবন সংগ্রামের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘Free Man’ চাইলে দেখতে পারেন, এখানে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ইন শা আল্লাহ ভালো লাগবে। ইউটিউব লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=2JeMsOc9Fsg&t=4s
লেখা: আহমাদ আমিন।
Rate this post