মহামারী বা সংকটকালে কুরবানী সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা

মুসলিম উম্মাহের সর্ববৃহৎ ও দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা। আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম কুরবানি। এ দিনে সর্বোচ্চ ত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে মানুষের সর্বাধিক প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে হয়। কুরবানী করা ওয়াজিব। এর গোশত বিতরণ সুন্নত। এমনকি এর গোশত খাওয়াও সুন্নত। ঈদুল আযহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতটির নামে। আল্লাহ তায়ালা এ দিন নামায আদায়ের পাশাপাশি কুরবানী করারও হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.

-সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামায পড় ও কুরবানী দাও। (সূরা কাউসার-২)

সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি যে, কুরবানী কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত।
কিন্তু বর্তমান এই করোনা পরিস্থিতির জন্য অনেকের সামর্থ্য থাকার পরেও কুরবানী দিতে অনিহা প্রকাশ করছেন। যা মোটেও কাম্য নয়। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- তোমরা কুরবানির গোশত নিজে খাও এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থকে খাওয়াও।(সূরা হাজ্জ্বঃ২৮)

তাই করোনা মহামারীর এই সময়ে কুরবানির গুরুত্ব কম নয়, বরং আরও বেশি। অভাবী লোকদেরকে খাদ্য খাওয়ানোর জন্য ইসলামে যথেষ্ট তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আর এই কুরবানী হলো অভাবীদেরকে খাদ্য দানের বিশেষ একটি মাধ্যম। এবং আমরা জানি, কুরবানির গোশতে অভাবীদের সরাসরি অধিকার রয়েছে। সুতরাং এই মহামারী কালে যদি ধনীব্যক্তি কুরবানী না করে তাহলে অভাবীরা সেই অধিকার থেকে আরও শক্তভাবে বঞ্চিত হবে। কেননা তারা সারা বছর টাকার অভাবে গোশত কিনে খেতে পারেনা। আর এই ঈদের দিনাটাতেও গোশত খেতে পারবে না। এজন্য সকল সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে কুরবানী, ইসলামের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিধান এবং ইসলামের একটি মহানুভবতার দিক।

আর গোশত বন্টন কুরবানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- কুরবানির গোশত থেকে তোমরা আহার করো ও যে অভাবী মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী হাত পাতে। তাদেরকে আহার করাও।’ (সূরা হাজ্জ : ৩৬)।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির গোশত সম্পর্কে বলেছেন -‘তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে খাওয়াও এবং সংরক্ষণ করো’।
(বুখারী, হাদিস নং৫৫৬৯;সহীহ মুসলিম, হাদিস নং১৯৭১)

সুতরাং বোঝা গেল যে, কুরবানির গোশত নিজেদেরকে খেতে হবে এবং অভাবী লোককে দিতে হবে। এই সম্পর্কে অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির গোশত একভাগ পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ গরীব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ গরীব মিসকিনদের দিতেন। এই হাদিসটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কুরবানির গোশত আমাদেরকে তিনভাগ করতে হবে। তার মধ্যে একভাগ নিজেদের জন্য রেখে বাকি দুইভাগ বন্টন করতে হবে। তবে কেউ চাইলে সে তার কুরবানির সম্পূর্ণ গোশতকে বিতরণ করে দিতে পারবে।

যে একভাগ গোশত প্রতিবেশিদের বিলানোর কথা বলা হয়েছে তা বিলাতে গিয়ে অনেকেই একটা সমস্যায় পরে যায়। তা হলো, অমুসলিম প্রতিবেশিকে কুরবানির গোশত দেওয়া যাবে কি না। কুরবানির গোশত হতে অমুসলিম অভাবী হলে তাকেও দেয়া যায়। তাকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করার জন্য এটি বৈধ। আর তা ইসলামের এক মহানুভবতা। (মুগনী,১৩/৩৮১;ফাতহুল বারী;১০/৪৪২)

কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে একটা মারাত্মক রোগ লক্ষ করা যায়। তা হলো, প্রদর্শনেচ্ছা। অনেকেই অনেক বড় ও মোটাতাজা পশু কুরবানী করে এলাকার মানুষকে দেখানোর জন্য বা নাম কেনার জন্য। আবার অনেকের সামর্থ্য আছে অথচ নিয়ত নেই। কিন্তু কুরবানী না দিলে মানুষ কি ভাববে এই জন্য কুরবানী দেয়। যা মোটেও ঠিক নয়। বরং আরও কবিরাহ গুনাহ। কারণ রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত, সবচেয়ে মারাত্নক গুনাহের কাজ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া। (সূরা হজ্জঃ৩৭)

তাহলে ইবাদাত কালে আমাদের মনের অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ? এই প্রশ্নের উত্তর মহান আল্লাহই অত্যন্ত চমৎকার ভাবে দিয়েছেন-

وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَ.

-আর তারা যা দেওয়ার তা দেয় ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এজন্য যে, তাদেরকে নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে (সূরা মু’মিনূন-৬০)
আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে কোন ইবাদত ও যে কোন দান বা বিতরণ এরকম ভীত ও কম্পিত মনেই হওয়া উচিত। এটাই আসলে ইবাদতের প্রাণশক্তি।

করোনার এই কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক ভাবে গোশত বন্টনের জন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। তা হলো-
১.ঈদের দিন আসার আগেই গরীব ও অভাবীদের একটা তালিকা করা। যাতে কেউ বাদ না পরে।
২.গোশত পৌঁছানোর জন্য আগেই প্যাকেট সংগ্রহ করে রাখা। যাতে ঈদের দিন ঝামেলায় পড়তে না হয়।
৩.গোশত গুলো যাতে আমরা উপহার হিসেবে পৌঁছাতে পারি সেই ব্যবস্থা করা। যাতে আমার দেওয়া গোশত নিতে কেউ লজ্জা না পায়।

আরো একটা লক্ষনীয় দিক হলো কুরবানির বর্জ্য অপসারণ ব্যাবস্থা! এজন্য আমাদের দুইটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে-
১.কুরবানির পশুর বর্জ্য কোথায় ফেলবো তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা।
২.ঈদের দিন কুরবানি পরবর্তী সময়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বর্জ্য অপসারণ করা।

কেননা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩)। তাই পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আমাদের খুবই গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল রাখতে হবে। মহান রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)।

গবেষকেরা করোনার সচেতনতা হিসেবে বলছেন, “আমাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে”। সুতরাং এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে এবারের কুরবানি ঈদ উদযাপন করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, সামর্থ্যবানদের এই করোনা পরিস্থিতির কথা ভেবে কুরবানি দেওয়া থেকে দূরে না থেকে বরং সাধ্যানুযায়ী কুরবানি করা। আর তাতে যেন না থাকে কোন প্রদর্শনেচ্ছা। থাকে যেন খালিছ দিল, সাচ্চা নিয়ত। এই মহামারী পরিস্থিতিতে আমরা কুরবানির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালনের মাধ্যমে যেন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আর এই ঈদ যেন বয়ে আনে আমাদের সমাজ জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও অনাবিল শান্তি। আল্লাহুম্মা আমিন।

জেসমিন খাতুন
শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

1/5 - (1 vote)