তাসাউফ কী?
তাসাউফ হলো ইসলামের আধ্যাত্মিক জীবন এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্বে প্রতিফলিত আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, যা সময়ের সাথে বিকশিত হয়ে আজ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এখানে “আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব” বলতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর “উসওয়াতুন হাসানা” বা অনুপম আদর্শিক ব্যক্তিত্বকে বোঝানো হয়েছে। যেমনটি জানা, নবীজি (সা.) তাঁর ব্যক্তিত্বে রাজনৈতিক, জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বকে একত্রিত করেছিলেন।
তাসাউফকে ইসলামী জ্ঞানের শিখর, সারাংশ ও মর্ম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাসাওউফের “হাল” বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দিকটি হলো এর রসাস্বাদন ও আত্মিক তৃপ্তির অংশ। যারা তাসাউফকে নৈতিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, তাদের মতে এটি একটি ইসলামী বিজ্ঞান যা নৈতিক পরিপূর্ণতা ও গুণাবলি অর্জনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কারণ এটি মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা ও খারাপ প্রবৃত্তিগুলো সংশোধনের জন্য কাজ করে এমন একটি নৈতিক ব্যবস্থা। নবীজি (সা.) মানুষের ইবাদত, আচরণ, লেনদেন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে হৃদয়ের গভীর অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে তাকওয়া অর্জনের জন্য অসংখ্য নির্দেশ ও অনুশীলন রেখে গেছেন।
মানুষের মধ্যে দুনিয়ার মোহ দূর করে ইবাদত ও বন্দেগির চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে এবং নবীজি (সা.)-এর বর্ণিত “যুহদ” বা বৈরাগ্যময় জীবন—যা আল্লাহ ও সৃষ্টির স্নেহ লাভের মাধ্যম—তা-ই পরবর্তীতে “তাসাওউফ” নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূল কারণ।
হাদিসের কিতাবসমূহে “জিবরীল হাদিস” নামে পরিচিত বর্ণনায় “ইসলাম”, “ঈমান” ও “ইহসান” ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা একটি পর্যায়ক্রমিক ও পরিপূর্ণতার দিকে উত্থানের চিত্র প্রকাশ করে। কারণ ইসলাম হলো বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশ ও মুখে স্বীকৃতির বিষয়। অন্যদিকে ঈমান হলো হৃদয়ের ঘটনা, যেখানে বিশ্বাস অন্তরে গেঁথে যায়। কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে:
قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَـٰكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَـٰنُ فِى قُلُوبِكُمْ ۖ وَإِن تُطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَـٰلِكُمْ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌ.
“বেদুইনরা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। বলুন, ‘তোমরা ঈমান আননি; বরং বলো, ‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি’, কারণ ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।” (সূরা আল-হুজুরাত: ১৪)। কুরআনে “মু’মিন” ও “মুসলিম” শব্দ একসাথে এসেছে এমন স্থানে “মুসলিম” প্রথমে উল্লিখিত হয়েছে, যা একটি স্তরবিন্যাস নির্দেশ করে। নবীজি (সা.)-এর হাদিস: “মু’মিন ব্যক্তি যিনা বা চুরি করে না” (ইবনে মাজাহ, ৩৯৩৬)—এটি ইঙ্গিত করে যে গুনাহ করলে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয় না কিন্তু ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে।
জিবরীল হাদিসে “ইহসান”কে “আল্লাহকে দেখার মতো করে ইবাদত করা” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ইসলাম ও ঈমানের উচ্চতর স্তর। কারণ ইহসান হলো মুমিনদের অর্জনের জন্য সাধনাসাধ্য এক প্রকার নিশ্চিত আত্মিক অবস্থা ও মনের প্রশান্তি। ইহসানে পৌঁছানো বান্দা “তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেখানেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে” (সূরা আল-বাকারা: ১১৫) আয়াতের রহস্য উপলব্ধি করে, তাই হারাম থেকে বেঁচে থাকা ও ফরজ আদায়ে সচেতন হয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
وَٱلسَّـٰبِقُونَ ٱلْأَوَّلُونَ مِنَ ٱلْمُهَـٰجِرِينَ وَٱلْأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحْسَـٰنٍۢ رَّضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُ.
“মু’মিনদের অগ্রগামীরা হলো মুহাজিরীন, আনসার ও তাদের অনুসরণকারী ইহসানকারীরা। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহতে সন্তুষ্ট।” (সূরা আত-তাওবাহ: ১০০)।
জিবরীল হাদিসে উল্লিখিত প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদা বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে: ইসলাম ফিকহের, ঈমান আকাইদ ও কালামের, আর ইহসান তাসাওউফের আলোচ্য বিষয়।
ইসলামী শরীয়তের আদেশ ও নিষেধ দুটি প্রকার: ১) যাহিরী (বাহ্যিক)—যেমন নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, মুখে স্বীকৃতি; ২) বাতিনী (অন্তর্নিহিত)—যেমন ঈমান, তাসদিক, তাওয়াক্কুল, শুকর, রিয়া, কিবর ইত্যাদি। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক মুসলিম বাহ্যিক আদেশ-নিষেধে সতর্ক হলেও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোতে উদাসীন। এর কারণ সম্ভবত শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় ফিকহের বাহ্যিক নিয়মকানুনে বেশি জোর দেওয়া হয়, অথচ অন্তরের পরিশুদ্ধির দিকটি উপেক্ষিত থাকে।
Writer: Pro. dr. Hasan Kamil Yilmaz
Translation: Ahmad Amin