বিতর্কঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে একটি পর্যালোচনা।

সত্যকে জানা এটা মানুষের সহজাত মনোবৃত্তি। মানব মনে প্রশ্ন আসবেই, এবং প্রশ্নের ধরণ বিচিত্র হবে মানুষের মনে বিচিত্র ভাবে চিন্তার প্রভাবের কারনে। তাকে ধমক দিয়ে বা যেন তেন ভাবে বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা সত্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা। চিন্তার ভিন্নতা প্রশ্নের ভিন্নতা তৈরি করে এবং প্রশ্নের উত্তর ও রকম ফের হয় উত্তর প্রদান কারীর নিজস্ব জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি, তথ্য উপাত্ত কম বেশি থাকা করনে। আর সেখান থেকেই তৈরি হয় বিতর্ক। কোন বিতর্ক প্রাসঙ্গিক আবার কোন বিতর্ক অপ্রাসঙ্গিক।

প্রাসঙ্গিক বিতর্ক বলতে আমরা সাধারণত এমন বিষয়ে আলোচনা বা পর্যালোচনার কথা বলতে পারি যা বুদ্ধিবৃত্তিক, যুক্তি ভিত্তিক এবং সত্য উম্মচনে সহায়তা করে, বা মানুষের কোন কল্যাণের কাজে আসে। অপ্রাসঙ্গিক বলতে আমরা বলতে পারি যে বিষয়ে সত্য উম্মচনের বিষয় থাকেনা বরং এক পক্ষের সংকীর্ণ উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার জন্য করা হয়, বা হীন স্বার্থ হাসিল করার জন্য কাউকে দোষারোপ করার উপাদান তৈরি করা হয়, যেখানে কোন কল্যাণের বিষয় থাকেনা। ইসলাম প্রথমত অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে চরমভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। বিনা কারনে তর্ক পরিহার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।

হজরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের পাশ্বদেশে, জান্নাতের মধ্যভাগে এবং জান্নাতের উপরিভাগে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে। যে ব্যক্তি সত্যাশ্রয়ী হওয়া সত্বেও তর্ক পরিহার করে, উপহাসস্বরূপ হলেও মিথ্যা কথা বর্জন করে, আর নিজের চরিত্রকে সুন্দর করে।“ (মুসনাদে বাযযার, তারগিব)

আল্লাহ তায়ালা বলেন, مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ، মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৮) তথা মানুষের মুখে উচ্চারিত প্রতিটি কথা মহান আল্লাহর দরবারে সংরক্ষিত হয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوقَ الأُمَّهَاتِ، وَوَأْدَ الْبَنَاتِ، وَمَنعَ وَهَاتٍ، وَكَرِهَ لَكُمْ قِيلَ وَقَالَ، وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ، وَإِضَاعَةَ الْمَالِ-

‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর মাতাদের অবাধ্যতা, কন্যাদের জীবন্ত প্রোথিতকরণ, কৃপণতা ও ভিক্ষাবৃত্তি হারাম করেছেন। আর তোমাদের জন্য বৃথা তর্ক-বিতর্ক, অধিক জিজ্ঞাসাবাদ ও সম্পদ বিনষ্টকরণ মাকরূহ করেছেন’ বুখারী হা/১৪৭৭, ৫৯৭৫; মুসলিম হা/৫৯৩; মিশকাত হা/৪৯১৫।

অন্যদিকে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক বা আলোচনার জন্য ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। যেখানে সত্যকে, সুন্দরকে পরিশুদ্ধভাবে উপস্থাপন করা হবে। পারস্পরিক ভুল্ বুঝাবুঝির বিষয়গুলো উঠে আসবে এবং একটি সুন্দর গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কুরআন বলছে
أُدْعُ إِلَى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَ الْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَ جَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ

মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন হিকমত (প্রজ্ঞা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের বিতর্কের জবাব দিন উত্তম পন্থায়। আলোচ্য আয়াতে কারিমায় আলাহ তায়ালা দায়ীদেরকে দাওয়াতের উত্তম পদ্ধতি শেখাচ্ছেন তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমেঃ (১) হিকমা (২) মাওয়িজা (৩) মুজাদালাহ বিল আহসান।

মুজাদালাহ বিল আহসান বা উত্তম পন্থায় বিতর্কের জবাব দেবার জন্য যোগ্যতা অর্জন করা জরুরী। আলোচ্য আয়াতে আমরা বুজতে পারি উত্তম জবাব হতে হলে কমপক্ষে দুটি গুন লাগবেঃ প্রথমত, হিকমাহ (জবাবটি হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ যা সঠিক বিষয়টি বুজতে সাহায্য করবে), দ্বিতীয়ত, মাওয়িজা (থাকতে হবে পরস্পরের কল্যাণ কামিতা, পাস্পরিক সম্মানবোধ।) কারন বিতর্কটি ব্যাক্তি কেন্দ্রিক নয়, কাউকে ছোট করার উদ্দেশ্যে নয় বরং সত্যকে উদঘাটন করার একটি প্রক্রিয়া। এই দুটি জিনিস আলোচনার মূলনীতি থাকলে পক্ষ, প্রতিপক্ষ নিজেদের হেরে যাবার ভয় থাকবেনা, বা ছোট হবার ভয়ে একরোখা নীতি গ্রহণ করবেনা, অথবা নিজেদের জিতে যাবার কৌশল গ্রহণ করবেনা, তখন সত্য জিতে যাবে। সেই বিতর্ক হেদায়াতের পথে ধাবিত করবে। সত্যকে আল্লাহ তায়ালা তালাশ কারীর নাগালে এনে দিবেন।

মহান আল্লাহ্ বলছেন :
الَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ أَحْسَنَهُ أُولَائِكَ الَّذِيْنَ هَدٰهُمْ اللهُ وَ أُولَائِكَ هُمْ أُولُوا الْأَلْبَابِ
“যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং তার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। তাদেরকে আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন” (সূরা যুমার : ১৮)।
আল্লাহ পাক আমাদের সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করুন। আমীন।
লিখেছেন: মোঃ খালেদ হোসেন।
পি. এইচ. ডি. গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া।
5/5 - (1 vote)