বিশৃঙ্খল এই সমাজে দায় আসলে কার?
আরবি ‘ফাসাদ’ শব্দের অর্থ বিশৃঙ্খলা বা অন্যায়। আজ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফাসাদ, বিশৃঙ্খলা ও অন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এর জন্য আসলে দায়ী কে? তবে প্রশ্নের উত্তর সবার কাছে এক নয়। যেমন- কেউ বলবেন সরকার দায়ী, কেউ বলবেন আমেরিকা দায়ী, কেউ বলবে ভারত দায়ী, আবার কেউ কেউ বলবেন- না না এসব কিছুর জন্য ইহুদিরাই দায়ী, ওরা হলো নাটের গুরু।
সবার কথাতেই নিশ্চয় কোনো যুক্তি আছে। তবে এই ব্যাপারে পবিত্র কোরআন কী বলে তা দেখা উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদের তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম, আয়াত:৪১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘তাফসিরুল ওয়াসিত’ গ্রন্থের প্রণেতা ড. মুহাম্মদ সাইয়্যেদ তানতাভি (রহ.) বলেন, জলে ও স্থলে বিশৃঙ্খলার কারণ হলো- মানুষ গুনাহ ও প্রবৃত্তির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলার আদেশ ও নিষেধের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করার কারণে। আল্লাহ তাআলা অপর এক আয়াতে আরো স্পষ্ট করে বলেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা, আয়াত:৩০)
পবিত্র কোরানের এই সব আয়াত থেকে যে বিষয়টি প্রতিয়মান হয়, তা হল আসলে আমরা সবাই আমাদের সমাজের এই ফাসাদের কারণ। কেউই দায় মুক্ত নয়, বরং আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে সমাজ বিনির্মানের জন্য ভূমিকা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকই দায়িত্বশীল আর তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আমাদের গবেষণা মতে, আজ সমাজের ফাসাদের জন্য পাঁচটি স্তর দায়ী। আর তা হল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ, বিশ্বব্যবস্থা। আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু এই পাঁচটি স্তরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ব্যক্তি দায়ী সর্বাগ্রে
সমাজের প্রত্যেকটি মানুষই চায় ভালোভাবে বেঁচে থাকতে। সেজন্য অন্যের ওপর ভরসা করে থাকার কোনো অবকাশ নেই। নিজেকে গড়ার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও অবিরাম প্রচেষ্টা। একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে জ্ঞান অর্জন ও তার সঠিক প্রয়োগেরও ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কেননা শুধু জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না বরং সেই জ্ঞানের আলোকে নিজেকে পরিচালিত করতে হবে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব তা হল আমরা নিজেদের কে পবিত্র কোরআন ও সূন্নাহের আলোকে আমাদের জীবন গঠন করা। সত্যকে সত্য—হিসেবে মেনে নেওয়া। আর মিথ্যাকে মিথ্যা—হিসেবেই পরিহার করা। আর আমরা যখন সঠিকভাবে নিজেকে গঠনে সচেষ্ট হবো, তখন আল্লাহ তাআলা ও তার রহমতের দ্বার আমাদের জন্য উন্মোচন করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করবো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন। (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে কষ্ট স্বীকার করে, সে তো নিজের জন্যেই কষ্ট স্বীকার করে। আল্লাহ বিশ্ববাসী থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ০৬)
কাজেই কোনো ব্যক্তি যদি নিজকে গড়ার চেষ্টা না করে, তাহলে সে নিজেই দায়ী। জ্ঞানের দাবী অনুসারে ভালো-মন্দে গড়মিল করে, তাহলে অবশ্যই ব্যক্তি নিজেই দায়ী। এ জন্য ব্যক্তি সংশোধনের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবার দায় এড়াতে পারে না
মানবিক জীবনে উন্নতির পথে পরিবারের ভূমিকা অনেক বেশি। পরিবারের অবহেলা আর অনিয়মের জন্যও রয়েছে বড় ধরনের বিপদ-আপদ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আজকে আমাদের সমাজের অধিকাংশ পরিবারেই ইসলামের সঠিক চর্চা নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই। কিন্ত এরপরও আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ নেই। প্রতিটি পরিবারের যারা মুরব্বি-বর্ষীয়ান তাদের উচিত, অধীনস্থদের ব্যাপারে সঠিক দায়িত্ব পালন করা। আমরা যদি নিজেদের সন্তানদের সঠিকভাবে দিক-নির্দেশনা দেই, তাহলে তারা আলোর সন্ধান পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়,কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয় তাই করে।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ০৬)
সমাজেরও দায় আছে অনেক
আমাদের সমাজব্যবস্থাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। আজকে সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা বলতে গেলে অনুপস্থিত। অধিকাংশ মানুষই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অন্যকে নিয়ে ভাবার সময় কারো নেই। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, ‘পরস্পর হিংসা করো না, একে অপরের জন্য নিলাম ডেকে দাম বাড়াবে না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করবে না, একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যেও না, একজনের ক্রয়ের ওপর অন্যজন ক্রয় করো না, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও। মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করে না এবং তাকে সঙ্গীহীন ও সহায়হীনভাবে ছেড়ে দেয় না। সে তার কাছে মিথ্যা বলে না এবং তাকে অপমান করে না। তাকওয়া হচ্ছে এখানে, [তিনি নিজের বুকের দিকে তিনবার ইশারা করেন।] কোনো মানুষের মন্দের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে আপন মুসলিম ভাইকে নীচ ও হীন মনে করে। এক মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও মান-সন্মান অন্য মুসলিমের জন্য হারাম।’ (মুসললিম, হাদিস: ২৫৬৪)
দেশ অবহেলা করলে ক্ষতি হয় বৃহৎ
একটা দেশের সরকার তার জনগণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। আল্লাহ তাআলা আখেরাতে তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন। দেশের মধ্যে দুর্নীতি, জুলুম, ব্যভিচারসহ সব ধরনের অন্যায় কঠোর হস্তে দমনসহ সর্বক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং আইনের সঠিক বাস্তবায়ন সরকারে দায়িত্ব। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমির তার অধিনস্থদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং সে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (মুসলিম ও বুখারি)
বাস্তবতার নিরিখে তাকালে দেখা যায়, আজ সারা বিশ্বই ফিতনা ও ফাসাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সবজায়গা থেকে শোনা যায় মাজলুমের করুণ আর্তনাদ। ‘জোর যার মুল্লক তার’ এই নীতির ওপরে প্রতিটি ক্ষেত্র পরিচালিত হচ্ছে। অনিয়ম, অত্যাচার ও শোষন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে।
বস্তুত একটি সুন্দর পরিবার, সমাজ, ও দেশ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। তাই আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। যদি ব্যর্থ হই, তাহলে প্রত্যেকেই আল্লাহর দরবারে অবহেলার কারণে জবাব দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের রক্ষা করুন।
লেখা: মোহাম্মদ নাজমুল হাসান