রাসুলে পাকের উপর কটূক্তি ও বেয়াদবির মোকাবেলায় আমাদের করণীয়
হযরত আদম আঃ থেকে শুরু করে মহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ পর্যন্ত যত আম্বিয়া আঃ এই জগতে এসেছেন সমস্ত নবীদের মিশন ছিল, মানুষ মানুষের কাছে গোলামীর জিঞ্জীরে আটকে থাকা দাসত্বের বাধনকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে জমিনে শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রিয় বান্দা রুপে মানুষগুলোকে পরিণত করা। তারা পৃথিবীতে এসেছেন বলে আকাশে এখনো সূর্য উঠে, রাতে চাঁদ উঠে, স্বাভাবিক গতিতে পৃথিবী চলমান। কারন মানুষগুলো যদি আল্লাহর পরিচয় না লাভ করত, তাকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে গ্রহণ না করত আল্লাহর কাছে এই পৃথিবী বাচিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন থাকত না। চাঁদ, সূর্য, গ্রহ উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজী, সাগর, মহাসাগর, এমনকি এই বিশ্বের প্রত্যেকটি অণু, পরমাণু, আল্লাহর যিকির করে বলে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব চরিত্র বজায় রেখে আল্লাহ পাক তাদের পরিচালনা করছেন। কোরআন বলছে
أَفَغَيْرَ دِينِ اللّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ.
অর্থাৎ “তারা কি আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্য জীবন ব্যবস্থা তালাশ করছে? নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক তার সামনে মাথা নত করে দিয়েছে। সবাই তার কাছে ফিরে যাবে।” সুরা আল-ইমরান। আয়াত নং ৮৩।
সুরা হাসরের শেষ আয়াতে আল্লাহ পাক আরও বলেন
هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاء الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“তিনিই আল্লাহ তা’আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নাম সমূহ তাঁরই। নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” এই আল্লাহর আনুগত্য ও তাসবিহ এই সৃষ্টি জগতকে প্রানে বাচিয়ে রেখেছে।
সুতরাং এই পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বেচে থাকার জন্য আল্লাহর গোলামী ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সেই কাজটি প্রতিষ্ঠার লক্ষে সবথেকে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন আম্বিয়া আঃ। তারা হচ্ছেন এই জগতের শ্রেষ্ঠ সন্তান,ও মহামানব, তাদের দাওয়াতের মাধ্যমে অজ্ঞ, মূর্খ, অবাধ্য মানুষগুলো আল্লাহকে চিনল, অগনিত মানুষ আল্লাহ ওয়ালায় পরিণত হলো। এই জগত ধ্বংস থেকে এখন পর্যন্ত টিকে থাকল। এই জন্য, এই বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি আল্লাহর কাছে স্রষ্টা হিসেবে, মাবুদ হিসেবে, রব হিসেবে যেমন ঋণী, তেমনি নবীদের কাছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দায়ী হিসেবে ঋণী। তাই মুসলমানরা কোন নবীকে গালি দেয়া তো দুরের কথা সমস্ত ওলামারা একমত, নবীদের শান, মান খাটো করা কুফুরি। এই জন্য মুসলমানরা কোন নবীর নাম উচ্চারণ করার সময় শ্রদ্ধা, তাজীমের সাথে উচ্চারণ করে। নামের শেষে বলে আলাইহিসসালাম, তাদের প্রতি সালাম।
মহাম্মাদুর রাসুলুল্লহ সাঃ হচ্ছেন সপ্ত জমিনের শেষ প্রান্ত তাহতাস-সারা থেকে শুরু করে ঊর্ধ্ব- জগতের শেষসীমা আরশে আজিম পর্যন্ত অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া বাকি যা কিছু আছে সমস্ত কিছুর চাইতে সম্মানিত মহামানব। সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমত। সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য রাসুল। কোরআন বলছে, আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সমস্ত মানব মণ্ডলীর জন্য সুসংবাদ দাতা রুপে এবং ভয়প্রর্দশনকারী রুপে বা সতর্ককারীরুপে। (সুরা আহযাব, আয়াত-৪৫) তিনি সমস্ত নবীদের ও নবি। ও সমস্ত নবীদের নবুয়তের সাক্ষী ও সার্টিফিকেট দান কারি। তিনি যদি না আসতেন সমস্ত নবীদের নবুয়ত মিথ্যা হয়ে যেত। কারন আল্লাহ পাক যত নবী প্রেরণ করেছেন সমস্ত নবীরা তাদের উম্মতদেরকে মহাম্মাদ সাঃ আসবেন এই সু সংবাদ দিয়ে গিয়েছেন, তিনি যদি না আসতেন তারা মিথ্যায় পরিণত হতেন। নবীরা কখনো মিথা বলেন না।
তিনি যদি না আসতেন এই পৃথিবীতে জংগলের জন্তু, জানোয়ারেরা বসবাস করত, মানুষের বসবাস হত না। অথবা এই পৃথিবীটাই আল্লাহ পাক ধ্বংস করে দিতেন। আল্লাহর কাছে তার কোন গুরত্ব ই থাকত না। আমাদের আগমন হত না। এই সুজলা, সফলা সবুজ পৃথিবীর স্বর্গ রাজ্য আমাদের দেখা হত না। নির্মল বাতাসে আমাদের প্রান জেগে থাকত না। অথচ সেই মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর প্রতি কি আচরণই না করল সেদিন তায়েফের যুবকেরা। পাথর নিক্ষেপে এত রক্ত ঝরাল রক্তে পায়ের তলা জোতার সাথে লেগে গেল। বেহুশ হয়ে পরে গেলেন জমিনে, আবারো জোর করে দাঁড় করানো হোল তাকে। এইভাবে তিন বার তাকে বেহুশ করা হলো। এই কারনে যে তিনি এই পথ হারা মানুষগুলোকে আলাহর গোলামীর দাওয়াত দিচ্ছেন। এই মানুষগুলো যেন আল্লাহর গজব আর আজাব থেকে বেচে যায়। ইব্রাহীম আ; এর সন্তানদের মত তাদের সন্তান গুলো যেন আল্লাহর যোগ্য বান্দা হয়ে সম্মানের সাথে এই জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।
রাসুলে পাকের কাছে আমরা এতটাই ঋণী, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ গুলো যদি তাদের কলিজার চামড়া দিয়ে রাসুলে পাকের পায়ের তলায় জুতা বানিয়ে দেয় তার পরেও উম্মতের জন্য বর্ষার বৃষ্টির মত ঝরে পরা অশ্রু জল আর উহুদের, তায়েফের রক্তের ঋণ শোধ হবে না।
কিন্তু হায় আফসস, রাসুলের আবদান স্বীকার করা তো দুরের কথা কিছু মানুষ তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। আবু জেহেল, উতবা, শায়বা, মুগিরা সম্প্রদায় রাসুল কে কষ্ট দিয়ে, বেয়াদবি করে আনন্দ পেত, আজ ও তাদের উত্তরসুরীরা এক ই কাজ করে যাচ্ছে। ওয়ৃলিদ ইবনে মুগিরা যখন রাসুল সা: কে পাগল বলে গালি দিল, রাসুলে পাক সা; মনে খুব কষ্ট পেলেন। আল্লাহ পাক তার হাবিব কে শান্তনা দিয়ে কোরআনে কারিমের আয়াত নাজিল করে মুগিরার গালির রিপ্লাই দিলেন। তার নিকৃষ্ট চরিত্র গুলো সবার সামনে প্রকাশ করলেন। কোন চরিত্রের মানুষ গুলো নবীদের সাথে, আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে বেয়াদবি করে তাদের দোষগুলো এই আয়াতে পাওয়া যায়। সূরা আল ক্বলামঃ ১০-১৩ আয়াতে ওলিদ ইবনে মুগিরার নয়টি নিকৃষ্ট চরিত্রের কথা আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন।
“১. সে মিথ্যা শপথ কারী; ২. মর্যাদাহীন; ৩. নিন্দুক (গীবতকারী); ৪. চোগলখোর; ৫. সৎকাজে বাধা দানকারী; ৬. জালেম (সীমালংঘনকারী); ৭. চরম পাপিষ্ঠ (ঝগড়াটে); ৮. পাষান হৃদয়, এবং সর্বশেষ আল্লাহ বললেন সে ৯. জারজ সন্তান।”
ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা এ আয়াত শুনে তার মায়ের কাছে গিয়ে বললো- মুহাম্মদ (সাঃ) আমার নয়টি দোষ বর্ণনা করেছেন, যার আটটি আমার নিজের ভেতর আমি পেয়েছি।, ঐ সকল দোষ আমার মধ্যে রয়েছে, তবে জারজ সন্তান কিনা, এ দোষের ব্যাপারে একমাত্র তুমিই বলতে পারো। সত্যি সত্যি বলো, আমি জারজ সন্তান কিনা? অন্যথায় তোমার গর্দান দু’টুকরা করে ফেলবো, মুহাম্মদ (সাঃ) এর কথা কখনো মিথ্যা হয় না। তদুত্তরে ওর মা বললো, তিনি একদম ঠিক বলেছেন, তুমি ঠিকই জারজ সন্তান। তোমার বাপ ছিলো পুরুষত্বহীন, কিন্তু অনেক সম্পদের অধিকারী। আমি মনে করলাম যে, আমার কোনো সন্তান না হলে ধন- সম্পদ অন্যরা নিয়ে যাবে। সেজন্য এক রাখালের সাথে যিনা করেছিলাম, তুমি তারই ঔরসজাত (সন্তান)
সুতরাং যারা আম্বিয়া আঃ দের গালি-গালাজ করে, সৎ, আল্লাহ ওয়ালাদের কটূক্তি করে বুঝতে হবে তারা ঐ চরিত্রের লোক। তাদের কাছে মানুষ তো দুরের কথা রাস্তার কুকুর ও নিরাপদ নয়। মানুষের ঘৃণা, বদদোয়া, আল্লাহর গজবে তাদের জিন্দেগী শেষ হয়েছে। যুগে যুগে এই চরিত্রের মানুষেরা মুসলমানদের দুর্বলতা ও বিভাজনের সুজুগকে কাজে লাগিয়ে বারবার রাসুলে পাকের উপর নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। এক দিকে কাদিয়ানীবাদ, অন্যদিকে সেকুলারিজমের নামে কিছু উগ্র মানসিক বিকৃত গোষ্ঠীরা আল্লাহর রাসুল, সাহাবায়ে কেরাম, উম্মুল মু,মিনিন, হক্কানি ওলামায়ে কেরামদের চরিত্রে কালিমা লেপনের নির্লজ্জ খেলায় মত্ত। উম্মতে মুহাম্মাদীর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য বাস্তবসম্মত, কঠিন পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে নিন্মের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
- রাসুলে পাকের সিরাত বা মহান জীবনের উপর বেশি করে আলোচনা ও সব জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া।
- সুন্নাতে নববির উপর বেশি পরিমাণে আমল করা, প্রতিটি সুন্নতের পেছনে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও উম্মতের কল্যাণের বিষয়ে আমাদের অন্তরে গেথে দেয়ার চেষ্টা করা।
- যারাই আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের উপর কটূক্তি করবে তাদেরকে কিভাবে মোকাবেলা করা যায় শিক্ষাবিদ, ওলামা, মাশায়েখ, গবেষণা করে একটি সমন্বিত প্লাটফর্ম তৈরি করা।
- প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া। কোন রাষ্ট্র যদি এই কাজ করে মুসলিম রাষ্ট্র সমুহের নেতৃবৃন্দেকে তার সমুহ জবাব দেয়ার জন্য প্রেসার তৈরি করা ও গাইড করা।
- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গন-মাধ্যমে এই গর্হিত কাজের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ ব্যক্ত করা।
- খতমে নবুয়ত ও শানে রেসালাতের ব্যাপারে উম্মতের সর্বস্তরের সাথে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তৈরি করা। কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্র সমুহকে বাধ্য করা।
- যারা এই অন্যায় আচরন করবে তাদের কুৎসার পরিবর্তে আমাদের আদর্শ, উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে রাসুলে পাকের উত্তম আদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
আল্লাহ পাক আমদের সহিহ বুজ দান করুন। আমিন।
মোঃ খালেদ হোসেন
লেখক, পি এইচ ডি, গবেষক।
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া।