ইসলামে আদব-শিষ্টাচারঃ পরিচিতি ও প্রয়জনীয়তা (১ম পর্ব) – At Tazkiah
আদব শব্দটির Semantic development বা শব্দার্থিক বিকাশ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।
প্রাচীন আরব তথা জাহেলী যুগে শব্দটি গণভোজের জন্য নিমন্ত্রণ বুঝাতে ব্যবহারীত হয়েছে। যেখানে দল, মত, গোত্র, ধনী – দরিদ্র নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আমন্ত্রিত হতো। এটা যেহেতু সর্বজন বিধিত ও স্বীকৃত সৎ কাজ সেহেতু প্রতিটি ভালো কাজকে আদব হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া আদব শব্দটি বদান্যতা, আতিথিয়তা, সামাজিকতা ইত্যাদী অর্থে ব্যবহারীত হয়েছে।
ইসলামের প্রথমিক যুগে আদব শব্দটি শিক্ষা, সংস্কার ও শিষ্টাচার অর্থে ব্যবহারীত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম ইরশাদ করেছন, আমার প্রতিপালক আমাকে আদব শিক্ষা দিয়েছেন, অতঃপর আমার আদবে সুন্দর রূপ দান করেছেন। এখানে আদব দ্বারা জ্ঞান ও শিষ্টাচার উদ্যেশ্য। ইমাম মানাভী বলেন, আদব হচ্ছে ব্যক্তির অর্জিত জ্ঞান ও উত্তম চরিত্র [ফাইযুল কাদীর, ১/২২৪]
যেহেতু মানুষ ভাল অভ্যাস ও কর্মের শিক্ষা ও অনুশীলন করে তাই এসব শিক্ষা, সংস্কার ও শিষ্টাচারকে আদব বলা হয়।
হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শব্দটি কোন কিছু সুচারুরূপে পালন করা বা ব্যক্তির করনীর নির্দেশ করতে ব্যবহারের প্রচলন ঘটেছে যেমনঃ “আদাবুল” কাদ্বী বা বিচারকের শিষ্টাচার/ করনীয়/ আবশ্যকীয় [ইবনে মানযুর, লিসানুল আরব, ১/৪৩]
এছাড়া হাদীস গবেষকগণ শিষ্টাচার সম্পর্কিত হাদিস সমূহকে আদাব অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন যেমনঃ “কিতাবুল আদাব” এই অধ্যায়ে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে রয়েছে যেমন- “আদাবুল ইস্তিযান” অনুমতি গ্রহণের আদব, “আদাবুন নাওম” বা ঘুমের আদব, “আদাবুল আকল ওয়াস শারাব” বা পানাহারের আদব ইত্যাদী।
হিজরী তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে আদব শব্দটি বিশেষ আদব ও সূফীদের অন্যন্ন শিষ্টাচার বর্ণনার্থে ব্যবহারীত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত সতন্ত্র পুস্তকও রচিত হয়েছে, যেমন ইমাম ইমাম আবু আব্দুল্লাহ হারিস ইবনুল আসাদ আল-মুহাসেবী [৭৮১-৮৫৭] (রহ) রচিত “আদাবুন নুফুস” বা নফসের আদাব, ইমাম আব্দুর রাহমান সুলামী [৯৪৭-১০৩৪] (রহ) রচিত “আদাবুস সুহবাহ” বা সুহবাতের আদব, এবং “আদাবুস সুফিয়্যাহ” বা সূফীদের শিষ্টাচার।
আদব হচ্ছে এমন কথা ও কাজ যা মানুষকে প্রশংসিত করে আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম হলেন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ভাবে সকল শিষ্টাচারে শিষ্ট ও সকল গুনে গুণান্বিত তাই তিনি মুহাম্মদ বা প্রশংসিত।
সর্বজন বিধিত উত্তম কাজঃ
শিক্ষা, সংস্কার ও শিষ্টাচার
ইসলামী আইন শাস্ত্রে আদবঃ শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের মতে আদব শব্দটির বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন যেমন,
১। ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ এর পর মুস্তাহাব। মুস্তাহাবকে আদাব হিসেবেও জানা হয়। মুস্তাহাব ঐ সকল কাজকে বলা হয় যা প্রশংসনীয় এবং পালনে প্রতিদান রয়েছে তবে না পালন কারী নিন্দনীয় হবেনা। [বাহারুর রায়েক, ৬/২৭৭]
২। আদব শব্দটি সুন্নাহ অর্থেও ব্যবহারীত হয় যা পালন করা প্রশংসনীয় এবং পালন না করা নিন্দনীয়।
৩। আদব হচ্ছে ঐ সকল কাজ যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম কখনো করেছেন আবার কখনো করেননি। আর সুন্নাহ হচ্ছে যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াস সাল্লাম নিয়মিত করতেন…। [আনিসুল ফুকাহা, ১/১০৬]
৪। আদব হচ্ছে এমন জ্ঞান যা দ্বারা সমস্ত ভুল ত্রুটি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর বিচারকের আদব হচ্ছে শরিয়া যা করতে আদেশ করে, যেমন ন্যায়বিচার প্রসারিত করা, অন্যায় দূর করা এবং পক্ষপাত ত্যাগ করা। [কাশশাফু ইস্তিলাহাতিল ফুনুন, ১/৫৪]
মূলকথাঃ আদব হচ্ছে, আদব হলো কাজ ও আচার আচরণের নির্ধারিত ইসলামি শিষ্টাচারকে বোঝায় যেমন “পরিমার্জন, ভাল আচরণ, নৈতিকতা, সাজসজ্জা, শালীনতা, মানবতা ইত্যাদী। যদিও আদবের ব্যাপ্তি ও বিশদ ব্যাখ্যা বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে, এই ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে সাধারণ আচরণের নির্দিষ্ট বিধান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত অবস্থানের জন্য বিবেচনা করা হয়। আদব প্রদর্শন করার অর্থ হচ্ছে “সঠিক ক্রম, আচরণ প্রদর্শন করা।
আদব ও আখলাকের মধ্যে পার্থক্যঃ
আখলাক হচ্ছে স্বভাব চরিত্র হোক সেটা ভালো অথবা খারাপ। আখলাক দুই প্রকার।
ক। আখলাকে হাসানাহ বা সদস্বভাব
খ। আখলাকে যামিমাহ বা মন্দস্বভাব
তবে আখলাক শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিবাচক বা সদস্বভাব বুঝাতে ব্যবহার হয়।
ইলমুল আখলাক বা নীতিশাস্ত্রের বিজ্ঞান যা অনুশীলন ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষ তাদের মন্দস্বভাব ত্যাগ করে নীতি নৈতিক, মার্জিত আচার আচরণ ও শিষ্টাচারের অধিকারী হতে পারে।
আখলাক হল নীতিশাস্ত্র, নৈতিক দর্শন, নৈতিকতা/নীতি। ইসলামি আচার-আচরণ, স্বভাব, সদাচরণ, স্বভাব, মেজাজ, নৈতিকতা, নৈতিকতা বা ব্যক্তির চরিত্র।
আদব হল “নৈতিক দর্শনের প্রকৃত অনুশীলন”; পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ এবং এগুলোকে তাদের যথাযথ জায়গায় ব্যবহার করার শিষ্টাচার “বিশুদ্ধ আচরণের সংস্কৃতি যা মুসলমানদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গঠন করে”
আখলাক নফসের সাথে সম্পর্কিত আর আদব মানুষের আচার আচরণের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং আদব হচ্ছে উত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।
আদবের গুরুত্বঃ
মানব জীবনে আখলাকের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব জিবনে আদব হচ্ছে আখলাকের প্রতিফলন আর উত্তম চরিত্র ইমানের প্রতিফলন কারণ মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ তার মনের আলোকেই সম্পাদিত হয়। অর্থাৎ মানুষের কোনো কাজই তার মূল চিন্তা-চেতনা বহির্ভূত নয়। এ জন্যই যুগে যুগে সংস্কারকরা মানুষের সংশোধন ও পবিত্র জীবন যাপনের পন্থা হিসেবে তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ও মূল্যবোধের জ্ঞান প্রথমেই শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে এগিয়ে আসে। [সূরা রা’দ, আয়াত ১১]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই প্রেরণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেন, ‘কিয়ামতের দিবস তোমাদের মধ্যে আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তী হবে তোমাদের মধ্যে যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী’। সৎ চরিত্রের অধিকারীর আমলনামাও ভারী হবে।
قال صلَّى اللهُ عليه وسلَّم: إنَّ من أحَبِّكُم إليَّ وأقرَبِكُم منِّي مَجلِسًا يَومَ القيامةِ أحاسِنَكُم أخلاقًا
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিবস তোমাদের মধ্যে আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তী হবে তোমাদের মধ্যে যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী’। [তিরমিযী, হাদিস নং ২০১৮]
قال صلَّى اللهُ عليه وسلَّم: ما من شَيءٍ أثقَلُ في الميزانِ من حُسنِ الخُلُقِ
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন, উত্তম চরিত্রের মতো অন্য কিছুই আমলনামায় এতো বেশী ভারী হয়না। [তিরমিযী, হাদিস নং ২০০৩]
قال صلَّى اللهُ عليه وسلَّم: إنَّ المُؤمنَ يُدرِكُ بحُسنِ خُلُقِه دَرَجاتِ قائِمِ اللَّيلِ صائِمِ النَّهارِ
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন, একজন মানুষ সুন্দর চরিত্র মাধুর্য দ্বারা মর্যাদার যে উচ্চাসনে পৌঁছে যান, সে উচ্চাসনে নিয়মিত নফল আদায়কারী ও রোজাদারও তার নামাজ ও রোজার দ্বারা পৌঁছতে পারে।’ [আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৭৯৮]
عن أبي هُرَيرةَ رَضِيَ اللهُ عنه، أنَّ النَّبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم قال: أكمَلُ المُؤمنينَ إيمانًا أحسَنُهم خُلُقًا، وخيارُكُم خيارُكُم لنِسائِهم
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, প্রকৃত মুমিন ঐ ব্যক্তি যে সব চেয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। [তিরমিযী, হাদিস নং ১১৬২]
إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا
তোমাদের মাঝে উত্তম সে, যে সর্বাধিক চরিত্রবান। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩২১
অন্য হাদিসে এসেছে,
أَكْثَرُ مَا يَلِجُ بِهِ الْإِنْسَانُ الْجَنَّةَ: تَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَحُسْنُ الْخُلُقِ
খোদাভীতি ও নেক চরিত্র এমন এক গুণ, যার উসিলায় অধিক হারে মানুষ জান্নাতে যাবে। [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৯০৯৬]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম আমাদেরকে দোয়া শিখিয়েছেন, তিনি দোয়ায় বলতেন, আল্লাহ তুমি আমার গঠন-আকৃতি সুন্দর করেছ, আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীবের উত্তম চরিত্রের প্রশংসাও করেছেন, তিনি বলেন, ‘আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত’। (সুরা কলম : ৪)
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ তায়লা কর্তৃক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলিহি ওয়াস সাল্লামের আখলাকের প্রশংসা করেছেন। পবিত্র কুরআনের প্রচুর আয়াতে আখলাকের বিবরণ ও চরিত্রবানদের প্রশংসার বাণী উদ্ধৃত হয়েছে, মাক্কী ও মাদানী উভয় সূরাগুলোতে আখলাকের নির্দেশ বেশি থাকায় এর গুরুত্বেরও আধিক্য বুঝা যায়, যা থেকে কোনো মুসলিমের দূরে থাকা অসম্ভব।
ইসলাম, ঈমান, মুয়ামিলাত ও ইহসান/আখলাকঃ ইসলামের ব্যপকতা এবং আদবের অবস্থান
ঈমানঃ ঈমান বা আকিদা বলতে নিমোক্ত বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনে ঈমানের প্রতিফলন ঘটানো।
ইবাদাতঃ ইবাদত বলতে নিম্নে উল্লেখিত পাঁচটি মৌলিক ইবাদত ছাড়াও কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত যাবতীয় কার্যক্রম ইবাদতের মধ্যে শামিল।
মুয়ামিলাত বা লেনদেনঃ লেনদেন বলতে অর্থনৈতিক লেনদেন ছাড়াও যাবতীয় রীতি নীতি, পদ্দতি, আইন, সম্পর্ক মুয়ামিলাতের মধ্যে শামিল।
আখলাকঃ
আদব ও আখলাক ইসলামের প্রতিটি বিধানের সাথে সংযুক্ত ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তাই পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে আদব। কুরআনের এ শিক্ষা এতই বিস্তৃত যে, জীবনের কোনো অঙ্গন এর বাইরে নেই। ইসলামী আদব ও আচরণবিধির বৈশিষ্ট্য ও বিস্তৃতি সম্পর্কে আলাদা আলোচনা প্রয়োজন। আপাদত আমরা এই বিস্তৃতিকে তিনটি দিক থেকে আলোচনা করতে পারি।
এক। স্রষ্টার সাথে আদব (খালিকের সাথে মাখলুকের আদব)
দুই। সৃষ্টির সাথে আদব (মাখলুখের সাথে মাখলুকের আদব)
তিন। স্ব ব্যবস্থাপনা (ব্যক্তি নিজেকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার আদব)