যুবকের হতাশা থেকে মুক্তির উপায় সবর ও শোকর
আমি আমার সমবয়সী বা সহপাঠীদের অর্থনৈতিক ও পারিবারিক উন্নতির দিকে তাকালে আবার নিজের অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থার দিকে তাকালে নিজের মধ্যে এক ধরণের হতাশা অনুভব করি। অনেকে সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশে গিয়ে বেশ টাকা কামিয়েছে, বিয়ে করে ছেলেসন্তানের পিতাও হয়েছে। এই দিক দিয়ে আমার এক্কেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থা।
এই অনুভূতি শুধু আমার না। আমি অনেকের কাছেই শুনেছি এমন অনুভূতির কথা। সমবয়সী ও সহপাঠীদের ছেলেসন্তান দেখা ও নিজে এখনও বিয়ে করতে পারার অবস্থাটা অনেকের মনেই গভীর দুঃখবোধের জন্ম দেয়।
এখন তো অত্যধিক ছেলে সন্তানকে বড় সম্পদ হিসেবে দেখা হয়নি। কিন্তু একসময় অনেক ছেলেমেয়ে হওয়া মানুষ অর্থনৈতিক সম্পদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মনে করতো। সব সমাজে সব সংস্কৃতিতেই সন্তানাদির গুরুত্ব ছিলো।
আগে ছেলে মেয়ে উভয়েরই কম বয়সে বিয়ে হতো। আমার দাদি নানীদের প্রজন্মে তা হয়তো ছিলো বারো তেরো, আবার আমার মায়েদের সময়ে তা বেড়ে পনেরো ষোল হয়, আমার বোনদের সময়ে তা আরও বাড়ে। এজন্য দেখা যায় আমার মায়ের যে বয়সে তাঁর ছেলে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে, আমার বোনের সে বয়সে তাঁর ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে।
ইমাম শাফেয়ী রহ. এক মহিলার দেখা পান যিনি বিশ বছর বয়সে নানী হয়েছেন। আমাদের কাছে তা বিস্ময়কর মনে হলেও সে সময়ে তা স্বাভাবিক ছিলো।
এবার আমরা যদি হযরত উসমান রা. এর জীবনের দিকে তাকাই তবে দেখব তাঁর জীবনটা এ যুগে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষায় ভরপুর। মনে স্বস্তি আসে তাঁর জীবনের দিকে তাকালে।
হযরত উসমান রা. ছিলেন অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের মানুষ। নম্রতা, লাজুকতা, দানশীলতা; এগুলো ছিলো তাঁর চরিত্রের উজ্জ্বল ভূষণ। এই লাজুকতার কারণে তিনি কোন নারীকে কখনো বিয়ের প্রস্তাবও দেন নি। যে সময়ে ছেলেদের পনেরো থেকে বিশের মধ্যে বিয়ে করা স্বাভাবিক ছিলো সে সময়েও তিনি পয়েত্রিশ বছর পর্যাপ্ত অবিবাহিত ছিলেন। পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যা রুকাইয়া রা.কে উসমান রা. এর সাথে বিয়ে দেন। তাঁদের এই দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে একটি ছেলে সন্তান জন্মলাভ করে। নাম ছিলো আব্দুল্লাহ।
বদর যুদ্ধে বিজয়ের দিন রাকাইয়া রা. ইন্তেকাল করেন। উসমান রা. নিজ হাতেই দাফন কাফন করেন। হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা রা. আনন্দচিত্তে বদর বিজয়ের খবর নিয়ে মদিনায় প্রবেশ করেই রাসূল কন্যার ইন্তেকালের মর্মান্তিক খবর শুনতে পারন। সে সময় উসমান রা. এর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি।
এসময় উসমান রা. একমাত্র পুত্র আব্দুল্লাহ এর বয়স ছিলো তিন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আরেক কন্যা উম্মে কুলসুম রা.কে উসমান রা. এর কাছে বিয়ে দেন। কয়েক বছর পর আব্দুল্লাহর বয়স যখন ছয় তখন এক পশুর আঘাতে আক্রান্ত হয় সেও মারা যায়। আরও কয়েক বছর পর। যথাসম্ভব ষষ্ঠ বা সপ্তম হিজরিতে উম্মে কুলসুম রা.ও ইন্তেকাল করেন।
এবার উসমান রা. এর দিকে তাকান। পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব বয়স। প্রথম ও একমাত্র স্ত্রীর ইন্তেকাল, একমাত্র সন্তানের ইন্তেকাল, দ্বিতীয় ও একমাত্র স্ত্রীরও ইন্তেকাল। এই পর্যায়ে এসে একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে! চারদিকে যখন উসমান রা. থেকে বয়সে ছোট এমনসব সাহাবীদের ছেলে ও নাতি নাতনি হয়ে গেছে, তখন তিনি নিঃসন্তান।
কিন্তু সবর ও ধৈর্যের ফলে উসমান রা.কে আল্লাহ পরবর্তীতে নয়টি সন্তান দান করেছেন।
এর থেকে আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পারি।
* নিজের অবস্থা নিয়ে দুঃখ না করে মাবুদের শোকর ও কৃতজ্ঞতার সাথে দিন যাপন করা।
* দুঃখের দিনগুলো অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা।
* খোদায়ী সিদ্ধান্তগুলোকে গ্রহণ করে অন্তরে সবরের সুন্দর প্রসাদ নির্মাণ করা।
* অন্যের দিকে না তাকানো, নিজের অবস্থাকে সবচেয়ে দারুন ও অসাধারণ মনে করা।
আমার পীর ও মুর্শিদ বদিউজ্জামান সাইদ নুরসির সমগ্র জীবনের সারমর্ম বা তাঁর জীবনকে তিনি সাজিয়েছিলেন তিনটি জিনিসের মাধ্যমে।
এক. ধৈর্য
দুই. সত্যবাদীতা
তিন. কৃতজ্ঞতা
আল্লাহ আমাদেরকেও শোকর ও সবরের সাথে জীবন পরিচালনার তৌফিক দিক। আমাকে ও সবাইকে উপরের কথাগুলো মেনে চলার তৌফিক দান করুক।
লেখক: শরিফ সাইদুর