বিসমিল্লাহর হাকিকত – শায়খ বদিউযযামান সাঈদ নুরসির কলম থেকে
বিসমিল্লাহ- সমস্ত কল্যাণ আর অর্থবহ কাজের চাবিকাঠি।
বিসমিল্লাহকে কী শুধু ইসলামের একটা নিদর্শন ভেবেছো? না। এটা পুরো সৃষ্টিজগতের নিরন্তর জিকরের নাম। প্রতি মুহুর্তে প্রতিটি দমে দমে সবাই তো বিসমিল্লাহ বলে চলেছে।
তুমি যদি বিসমিল্লাহর অপরিসীম শক্তি আর বিরাটকায় বরকত নিয়ে জানতে চাও, তবে আসো তোমাকে একটি গল্প বলি। মরুভূমির বেদুইনদের গল্প।
তুমি তো জানোই- মরুভূমি নানান বিপদাপদ আর প্রতিকূলতায় ভরা থাকে।
হঠাৎ এক মুখঢাকা তস্কর এসে পথ আটকাতে পারে। বিষমাখা খঞ্জর দিয়ে বুক চিরে তোমার সর্বস্ব কেড়ে নিতে পারে। খা খা মরুর তপ্ত বালুরাশিতে পানির অভাবে তুমি মারা যেতে পারো। মরুভূমিতে কোনো ফলের বাগান নেই যে ইচ্ছেমতো খাবে, কোনো জঙ্গল নেই যে, শিকার করে আগুনে ঝলসাবে।
তাই যে বেদুঈন একাকী মরুভূমিতে পথ চলে, তাকে অবশ্যই একজন গোত্র-সর্দারের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। তার নিরাপত্তার অধীনে থাকতে হয়। তখন শত্রুরাও তোমাকে সমঝে চলবে। তোমার প্রয়োজনও পূর্ণ হবে।
দুজন বেদুইন বন্ধুর কথা ভাবো। একজন বুদ্ধিমান, চৌকস। বিনয়ী সে একজন শক্তিশালী গোত্রপ্রধানের নিরাপত্তায় থাকে। তাই শত্রুরা তার সামনে আসে না। তার খাবারের খাঞ্চায় সুদূর পারস্য থেকে আনা পেস্তা বাদাম আর তায়েফ থেকে আনা আনার জায়গা করে নেয়। সে যে তাঁবুতেই যায়, সবাই সাদরে অভ্যর্থনা
জানায়। মুখ ঢাকা তস্কর আসলে সে বলে- শোনো আমি অমুক সর্দারের মানুষ।
তস্কর সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়।
আরেক বন্ধু একগুঁয়ে, অবাধ্য। বিভ্রান্ত। সে কারও নিরাপত্তায় থাকবে না। পথ চলবে একাকী। তার জীবনে বিপদাপদের অভাব নেই। দুনিয়ার যত মসিবত তার উপর এসে পড়ে। অজানা এক ভয় সবসময় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
ওহে বিভ্রান্ত নফস! জেনে রাখো! তুমিই মরুভূমিতে ভ্রমণরত বেদুঈন। এই বিস্তৃত দুনিয়া তোমার দিগন্তবিহীন মরুভূমি। তোমার দরিদ্রতা আর প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই, শত্রুরও কোন অভাব নেই। অবস্থা যখন এমন, তবে কেন সেই মহান মালিকের দ্বারস্থ হচ্ছো না- যিনি এই মরুর প্রকৃত মালিক: যার প্রবল প্রতিপত্তির সামনে সবাই মাথা নত করে!
সুলতানের সৈন্যদেরকে তো দেখেছো। যে সকাল বিকাল সমস্ত কাজে বিসমিল্লাহ দিয়ে করে, সে সুলতানের সৈন্যর মতো। সৈন্য রাষ্ট্রের নামে সব কাজ করে। কেউ তাকে কিচ্ছু বলার সাহস পায় না। সেও কাউকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। সে যে স্বয়ং রাষ্ট্রের হয়ে কথা বলছে, সেই যে রাষ্ট্রীয় আইনের ধারকবাহক। এজন্য সবার সামনেই সে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে, সব কাজ সমাধা করতে পারে।
শুরুতে তোমাকে বলেছিলাম, ‘সুষ্টিজগতের নিরন্তর জিকর এই বিসমিল্লিাহ’। আসলেই কী তাই?
বিসমিল্লাহর ওযিফা এই সৃষ্টিজগতের সবকিছুই পালন করে। ক্ষুদ্রতম বীজও এই বিসমিল্লাহর বদৌলতে তার ভেতর দানবাকৃতির বিশাল বটবৃক্ষ ধারণ করে। প্রতিটি গাছ বিসমিল্লাহ বলে ঐশী রহমতের খাযানা থেকে তার বাহুগুলোকে ফলেফুলে ভরিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরে। সবগুলো ফলের বাগানই তো বিসমিল্লাহ বলে আর এরপর আমাদের সামনে কত শত ধরনের খাবার নিয়ে আসে। উপকারী প্রাণীদল- উট, গরু কিংবা ছাগল- তারাও তো বিসমিল্লাহ বলে। সকালে দেখা যায় তাদের স্তন ধবধবে ফেনিল দুগ্ধে ভরে উঠেছে। এরপর তারা সেগুলো রাযযাকের নামে আমাদের সামনে পবিত্রতম খাবার হিসেবে পেশ করে। উদ্ভিদ আর ঘাসদলের সবাই বিসমিল্লাহ বলে আর তাদের ক্ষীণ বীজগুলো পাষাণ আর দুর্দম পাথর ফুড়ে বেরিয়ে আসে। কোমল শেকড় দিয়ে তারা কীভাবে পাথরগুলো ভেত করে ফেলে। আল্লাহর নামের জন্য, রহমানের নামের জন্য কঠিনতম কাজও তাদের সামনে সহজ হয়ে যায়।
শূন্য বায়ুতে বৃক্ষরাজির ডানা মেলে দেয়া আর ফুলে ফলে ভরে ওঠা, পাথরের ভেতর উদ্ভিদের জন্ম আর অন্ধকার মাটির ভেতর থেকে খাবার গ্রহণ, ভয়াবহ তাপদাহ সহ্য করেও পাতাগুলোও সতেজ আর সবুজ থাকা- সবই আসলে কারণের দোহাই দেয়া মানুষের মুখে একেকটি প্রবল চড়ের মতো। এরা বলছে, ‘তুমি তো কাঠিন্য আর তাপদাহের দোহাই দাও। দেখো এরা তো নিজেরা কাজ করে না। এরা এক আল্লাহর হুকমেই নিজেদের ওযিফা পালন করছে। আল্লাহই তো ঐ ক্ষীণ শেকড়গুলোকে মূসা আলাইহিস সালঅমের লাঠির মতো করে দিয়েছেন, যে লাঠি আল্লাহর আদেশ পালন করেছে। ফলে তার আঘাতে পাষাণ পাথর থেকেও ঝর্ণা প্রবাহিত হয়েছিল। তীব্র তাপদাহের ভেতরেও তিনি শেকড়গুলোকে এমন তরতাজা রেখেছেন, যেন সেগুলো ইবরাহীম আলাইহিস সালামের হাত পা। শেকড়গুলো পড়ছে- ওহে আগুন। তুমি শীতল আর আরামপ্রদ হয়ে যাও।
সৃষ্টিগজতের সবকিছু যেহেতু বিসমিল্লাহ বলে এর মাধ্যমেই আল্লাহর নেয়ামতরাজি নিয়ে আসছে, আমাদের সামনে দিচ্ছে; তাই আমাদেরও বিসমিল্লাহ বলা উচিত। বিসমিল্লাহর মাধ্যমে দান করা উচিত, বিসমিল্লাহর মাধ্যমে গ্রহণ করা উচিত। যেসব উদাসীন গাফেল বিসমিল্লাহ না বলে দেয়, তাদের হাতগুলোও ফিরিয়ে দেয়া উচিত।
সুলতানের সেই সৈন্যর কথা ভাবো। সুলতানের পক্ষ থেকে সে নানান হাদিয়া জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়। এখন যে লোক সুলতানের ঐ খাদেমের পায়ে চুমু খায় আর তাকেই দাতা ভাবে, সে কী বোকার মতো কাজ করে না? তবে যে নিয়ামত বয়ে আনে এমন পার্থিব বস্তুসামগ্রীকে ভালোবাসে; প্রকৃত নিয়ামতদাতাকে ভুলে এসব উপকরণ ঘিরে মগ্ন হয়ে থাকে, সে আরও আহম্মক। এর থেকে বড় নির্বুদ্ধিতা আর কী হতে পারে?
ওহে নফস! এমন নির্বোধ হতে না চাইলে বিসমিল্লাহ বলে দাও, বিসমিল্লাহ বলে গ্রহণ করো, বিসমিল্লাহ বলে শুরু করো, বিসমিল্লাহ বলেই কাজ করো।
ওয়াস সালাম।
[শায়খ নুরসি রা. এর কালিমাত-এর একটি অংশের ভাবানুবাদ। সোজলার থেকে প্রকাশিত ইহসান কাসিম সালিহির আরবি অনুবাদ থেকে]
লেখা: আব্দুল্লাহ যুবায়ের।