“সালাত দ্বীনের স্তম্ভ” -বদিউযযামান সাঈদ নুরসির (রহ.) কলম থেকে- (২)
সালাতের যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মূল্যবান। আবার এটা অর্জন করা খুবই সহজ।যে সালাত প্রতিষ্ঠা করে না, সালাতের হক আদায় করে না,সে নিতান্ত নির্বোধ আর ক্ষতিগ্রস্থ। দুইয়ে দুইয়ে যেমন চার হয়, তেমন নিশ্চিতভাবে যদি বিষয়গুলো বুঝতে চাও,
তবে নিচের ছোট্ট গল্পটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবো-
একদিন এক মহান শাসক তার দুই কর্মচারীকে একটি মনোরম শস্যক্ষেত্রে পাঠানোর চিন্তা করলেন। সেখানে পাঠানোর আগে তিনি দুজনের হাতেই চব্বিশটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দিলেন। শস্যক্ষেত্র বহুদূরের পথ-প্রায় দুমাস। এ সময়ের রাহাখরচে এটা কাজে লাগবে।
শাসক বললেন, ‘এই মুদ্রাগুলো দিয়ে টিকেট খরচ আর সফরের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে। ওখানে থাকার জন্য যা যা দরকার, তাও কিনে নেবে। এক দিনের পথ পেরোনোর পর তোমরা একটি স্টেশন পাবে। সেখানে ভ্রমণের সব রকমের ব্যাবস্থা আছে। গাড়ি আছে, প্লেন আছে, রেলগাড়ি আছে। এমনকি জাহাজও আছে। ওগুলোর কোনটাই বিনামূল্যের না।’
আদেশ নিয়ে কর্মচারী দুজন বেরিয়ে পড়লো। এদের একজন ছিল ভাগ্যবান। স্টেশনে পৌঁছার আগ পর্যন্ত নিজের টাকা সে খুব অল্পই খরচ করলো। যেটুকু করেছিল, তাও ছিল একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যাবসায় বিনিয়োগের জন্য- তার মালিক তাতে খুশিই হবেন। দেখা গেল, মূলধন ফুলেফেঁপে এক হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
আরেকজন কর্মচারীর অবস্থা এতো ভালো ছিল না। সে যেমন নির্বোধ তেমনি দুর্ভাগা। আমোদপ্রমোদ আর জুয়ার পেছনেই সে নিজের চব্বিশটা স্বর্ণমুদ্রার তেইশটাই খরচ করে ফেলল। স্টেশনে পৌঁছার পর দেখা গেল, তার কাছে একটা মাত্র মুদ্রা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
তার সঙ্গী বলল, ‘শোনো। এই মুদ্রাটা অন্তত এভাবে উড়িয়ে দিও না। এটা দিয়ে যাত্রার টিকেট কেনো। আমাদের মনিব তো অনেক দয়ালু, অনেক উদারমনা। তোমার যেসব দোষত্রুটি দেখা গেছে, সেগুলো উপেক্ষা করে তিনি তোমাকে দয়াও করতে পারেন; প্লেনে চড়ার অনুমতি দিতে পারেন। তাহলে আমরা একসাথেই আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছতে পারবো। আমার কথা না শুনলে তোমাকে দুমাসের পুরো পথটাই পায়ে হেঁটে যেতে হবে। তখন ক্ষুধায় কাতর হতে হবে, অজানা-অচেনা দীর্ঘ পথে চলতে হবে একদম একাকী।’
ভেবে দেখো, এই লোকটি যদি এখনও গোয়ার্তুমি করে বেঁচে যাওয়া একটি মাত্র মুদ্রাও স্বর্ণখনিসম টিকেট না কিনে নশ্বর উপভোগ আর কামনা-বাসনার পেছনে খরচ করে ফেলে; তবে কী সে সবচেয়ে নির্বোধ আর ক্ষতিগ্রস্থ নয়? সবচেয়ে বোকা মানুষটিও তো এটা বুঝতে পারে।
ওহে বেনামাযি! নামায পড়তে তোমার কষ্ট হয়! শোনো গল্পের ঐ শাসক হলেন আমার মহান প্রভূ আল্লাহ তায়ালা। ঐ সফররত দুজন কর্মচারীর একজন হলো দ্বীনদার, সে গভীর আগ্রহ নিয়ে সালাত আদায় করে। সালাতের হক যথাযথভাবে আদায় করে। আরেকজন মুসাফির গাফেল, বেনামাযি। ঐ চব্বিশটি স্বর্ণমুদ্রা হলো জীবনের প্রতিটি দিনের চব্বিশটি ঘণ্টা। সেই মনোরম শস্যক্ষেত্র হলো জান্নাত। আর স্টেশনটা হলো কবর।
এই দীর্ঘ সফরের ভেতর দিয়ে প্রতিটি মানুষকেই যেতে হয়। প্রথমে কবরের দিকে, যা হাশর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এরপর চিরন্তন জীবনের দিকে। দীর্ঘ এই পথ অতিক্রমে সবার একরকম সময় লাগে না। তাকওয়া আর আমলের প্রেক্ষিতে গতিতেও বৈচিত্র আসে। কেউ বিজলির মতো এক দিনের ভেতরেএক হাজার বছরের রাস্তা পেরিয়ে যায়। আবার কেউ দক্ষ ঘোড়সওয়ারের মতো পঞ্চাশ হাজার বছরের রাস্তা পেরিয়ে যায়। দুটি মহান আয়াতে কুরআন এদিকে ইশারা করেছে। আর যানবাহনে চড়ার সেই টিকেট হলো সালাত। ওযুসহ সারাদিনে পাঁচওয়াক্ত সালাত আদায় করতে এক ঘণ্টার বেশি লাগে না। [এজন্যই একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েই টিকেট কেনা সম্ভব ছিলো।]
ওহে দুর্ভাগা। দুনিয়ার এই ক্ষুদ্র জীবনের তেইশটি ঘণ্টা তুমি শেষ করে দিয়েছো। অথচ স্থায়ী আর দীর্ঘ সেই জীবনের জন্য একটি ঘণ্টা ব্যয় করতে পারবে না? তোমার চেয়ে নিজের উপর জালিম আর কে আছে? তোমার চেয়ে নিরেট আহম্মক আর কে হতে পারে?
মানুষ লটারিতে তার সমুদয় সম্পদের অর্ধেকও লাগিয়ে দেয়। সেখানে হাজারেরও বেশি লোক অংশ নেয়। তাই পুরষ্কার জেতার সম্ভাবনা হাজারে এক ভাগ। এরপরও একাজ বোধের অগম্য নয়। কিন্তু যে লোক নিজের সম্পদের চব্বিশ ভাগের এক ভাগও নিশ্চিত লাভজনক খাতে খাটাতে চায় না, চিরন্তন ধনভাণ্ডার পাবার জন্য ব্যয় করতে চায় না- অথচ এখানে সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বুই ভাগ- তবে এ কাজটা কেন বোধের অগম্য ধরা হবে না? কেন জ্ঞানবুদ্ধির পরিপন্থী ধরা হবে না? নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে, েএমন কেউ কী এটা না বুঝে থাকতে পারে?
আত্মা, হৃদয় আর বুদ্ধিমত্তা-সবকিছুর জন্যই সালাত এক বিরাট প্রশান্তির নাম। উপরন্তু শরীরের জন্য তেমন কঠিন কিছু নয়। আরও বড় ব্যাপার হলো সালাত আদায়কারীর সমস্ত পার্থিব বৈধ কাজই নেক নিয়তের বদৌলতে আল্লাহর ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। এভাবে মুসল্লি তার জীবনের সমস্ত মূলধনই আখিরাতে ট্রান্সফার করতে পারে। তখন পার্থিব এই নশ্বর জীবনকালের বদলে সে লাভ করে- এক চিরন্তন জীবন।
[নুরসি রাহিমাহুল্লাহ’র কালিমাত গ্রন্থ থেকে চতুর্থ কালিমার ভাবানুবাদ। তাঁর লেখায় কী একটা আকর্ষণ, একটা মনমোহিনী শক্তি। বক্তব্যে যেমন জাদু থাকে, লেখাতেও থাকে। আজকে স্কুলে টিফিনের সময় পড়েছি এ দুপৃষ্ঠা। এরপর ক্লাস থ্রিতে ঢুকবো। ঘণ্টা বাজলো ক্লাস শুরুর। কাঁসার ঘণ্টা। মনে হলো আমিই সেই টঙ্গী মাদরাসার ক্লাস টুর ছোট্ট বালক। ক্লাস শুরু হবে। জেলখানায় আধো-অন্ধকারে বসে বসে অনবরত লিখতে থাকা একজন জ্ঞানবৃদ্ধ সাঈদ নুরসি আমাদের ক্লাস নিবেন। ঈমানের নূরে কারার অন্ধকার ফাটক আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে…। রাহিমাহুল্লাহু রাহমাতান ওয়াসিয়াহ।]
লেখা: মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ যুবায়ের।