নিয়ত ও নিয়তের বিশুদ্ধতা – At Tazkiah

আল্লাহ তায়লা ইরশাদ করেন,

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ

“তারাতো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করতে…” [সুরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াতঃ ৫]

إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ

নিশ্চয় আমরা আপনার কাছে এ কিতাব সত্যসহ নাযিল করেছি। কাজেই আল্লাহর ইবাদাত করুন তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। [সুরা যুমার, আয়াতঃ ২]

فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে’। [সুরা কাহাফ, আয়াতঃ ১১০]

قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللهُ بِهِ

হযরত জুনদুব আল ’আলাকী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের উদেশে সৎ আমল করে আল্লাহ তা’আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশের কথা লোকেদেরকে শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশে কোন সৎ কাজ করে আল্লাহ তা’আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশের কথা লোকেদের মাঝে ফাঁস করে দিবেন।

عن أبى هريرة t قال: قال رسول الله r: إِنَّ اللهَ تعالى لَا ينظرُ إلى صُوَرِكُمْ وَأمْوالِكُمْ ، ولكنْ إِنَّما ينظرُ إلى قلوبِكم وأعمالِكم.

আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চাল-চলন ও বিত্ত-বৈভবের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি।

 

নিয়তঃ মনের ইচ্ছা, সঙ্কল্প বা প্রতিজ্ঞা করা।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়তের ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ রয়েছে যেমনঃ

ফিকহী দৃষ্টিকোণ, (Juristic perspective)

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ (Spiritual perspective)

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ (Psychological perspective)

 

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ (Spiritual perspective) থেকে নিয়তের স্তরঃ

নিয়ত, At Tazkiah

 

নিয়তের উপর ভিত্তি করে ইবাদত ও অভ্যাসগত কাজের পার্থক্য নির্ণয় হয়।

নিয়তের উপর ভিত্তি করে আমলের মান নির্ধারিত হয়।

নিয়তের উপর ভিত্তি করেই আমল কবুল হওয়া না হওয়া নির্ভর করে অথবা প্রতিদানে বেশি কমের তারতম্য ঘটে।

ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ) বলেন, “অনেক ছোট কাজ নিয়তের কারণে বড় হয় আবার অনেক বড় কাজ/ আমল নিয়তের কারণে ছোট হয়ে যায়”। [লাতাইফুল মায়ারিফ]

 

নিয়তের পরিশুদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের প্রধানত তিনটি অবস্থা হয়:

১। মুরায়ীঃ লৌকিকতাকারী

ইমাম আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) বলেন, লৌকিকতাকারী ব্যক্তির বাহ্যিক/ পোশাক পরিচ্ছন্ন তবে অন্তর অপবিত্র … তাঁর বন্দেগী ও দুনিয়া বিমুখতা শুধুমাত্র বাহ্যিক ভাবে। তাঁর বাহ্যিক অবস্থা জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু অন্তর খারাপ …[আল-ফাতহুর রাব্বানী, পৃষ্ঠা ৪১]

شَدَّادِ بْنِ أَوْسٍ رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَتَخَوَّفُ عَلَى أُمَّتِي الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ ، أَمَا إِنِّي لَسْتُ أَقُولُ يَعْبُدُونَ شَمْسًا وَلَا قَمَرًا وَلَا وَثَنًا ، وَلَكِنْ أَعْمَالًا لِغَيْرِ اللَّهِ ، وَشَهْوَةً خَفِيَّةً.  رواه ابن ماجه في ” السنن ” (رقم/4205)

শাদ্দাদ ইবনে আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি আমার উম্মাতের জন্য যেসব বিষয়ের ভয় করি তার মধ্যে অধিক আশংকাজনক হচেছ আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা। অবশ্য আমি এ কথা বলছি না যে, তারা সূর্য, চন্দ্র বা প্রতিমার পূজা করবে, বরং আল্লাহ ব্যতীত অপরের সন্তুুষ্টির জন্য কাজ করা এবং গোপন পাপাচার। [ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ৪/৪২০৫]

ইমাম গাজালী বলেন, “নিয়ত বিহীন আমল অযথা কষ্ট, আর ইখলাস বিহীন নিয়ত হলো লৌকিকতা” [ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন, ৪/ ৩৬২]

وقال علي كرم الله وجهه : للمرائي ثلاث علامات : يكسل إذا كان وحده وينشط إذا كان في الناس ، ويزيد في العمل إذا أثني عليه ، وينقص إذا ذم .

আলী (রাঃ) বলেন, লৌকিকতাকারী ব্যক্তির নিদর্শন তিনটি, একাকী অবস্থায় ইবাদাতে অলসতা করে, লোকালয়ে ইবাদাতে সক্রিয় হয়, প্রশংসায় আমল বেশী করে আর নিন্দায় আমল কমে যায়।

 

দুইঃ মুখলিসঃ একনিষ্টঃ

ইমাম গাজালী (রহ) বলেন,

فالناس كلهم هلكى إلا العالمون والعالمون كلهم هلكى إلا العاملون والعاملون كلهم هلكى إلا المخلصون والمخلصون على خطر عظيم. فالعمل ‌بغير ‌نية ‌عناء والنية بغير إخلاص رياء وهو للنفاق كفاء ومع العصيان سواء. والإخلاص من غير صدق وتحقيق هباء وقد قال الله تعالى في كل عمل كان بإرادة غير الله مشوباً مغموراً )وقدمنا إلى ما عملوا من عمل فجعلناه هباءً منثوراً( الإحياء 4/362.

“সব মানুষ বরবাদ হয়েছে শুধু মাত্র আলিমগণ ব্যতীত, আলিমগণ ধংশ হয়েছে শুধুমাত্র এদের মধ্যে আমলকারীগণ ব্যতীত, আমলকারীগণ ধংশ হয়েছে শুধুমাত্র এদের মধ্যে মুখলিসগণ ব্যতীত, আর মুখলিসগণ মহা বিপদের মধ্যে থাকবে। সুতরাং “নিয়ত বিহীন আমল অযথা কষ্ট, আর ইখলাস বিহীন নিয়ত হলো লৌকিকতা আর এটা মুনাফেকী ও অবাধ্যতার শামিল। সত্যবাদিতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া অনর্থক। আল্লাহ তায়লা বলেন, লৌকিকতা পূর্ণ প্রতিটি আমল ত্রুটিযুক্ত তিনি ইরশাদ করেন, “আমি ওদের কৃতকর্মগুলির প্রতি অভিমুখ করে সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণা (স্বরূপ নিষ্ফল) করে দেব। [ সুরা ফুরকান, আয়াত ২৩] [ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, ৪/৩৬২]

 

উস্তায আবু আলী আদ-দাক্কাক বলেন, ইখলাস হচ্ছে সৃষ্টির পর্যবেক্ষণ থেকে বাঁচা।

আবু ইয়াকুব আস-সুসী বলেন, তাঁরা যতদিন নিজেদের ইখলাসের মধ্যে ইখলাস দেখবে, ততদিন তাঁদের ইখলাসের ইখলাস করা প্রয়োজন।

আবু ওসমান আল -মাগরেবী বলেন, ইখলাস হল কোন অবস্থায় তমার নফসের কোন অংশ না থাকা।

আবু বকর আদ-দাক্কাক বলেন, প্রত্যেক মুখলিস ব্যক্তির ইখলাসের ত্রুটি হল স্বীয় ইখলাসকে দেখা

ফুদাইল ইবনু আয়াদ বলেন, আল্লাহ তায়লা শুধুমাত্র তোমাদের থেকে নিয়ত ও আকাংখাকে চান। [লাতাইয়িফুল মায়ারেফ]

বনী ইসরাইলে একসময় দুর্ভিক্ষ দেয়া দেয়। এক ব্যক্তি বালুময় স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে আকাংকা করেছিল যে, এই সব বালি পরিমাণ যদি আমার জন্য আটা হতো তাহলে আমি সবাইকে আহার করাতাম। আল্লাহ তায়লা তাঁর নিয়তের জন্য সাওয়াব দিয়েছেন [ইতহাফুস সাদাতুল মুত্তাকীন]

ইমাম যুন-নুন মিসরী (রহঃ) বলেনঃ বলেন, ইখলাসের নিদর্শন তিনটি- সাধারণ মানুষের প্রশংসা ও নিন্দা সমান হওয়া, নেককাজ করার সময় নেককাজ দেখতে ভুলে যাওয়া আর নেক কাজের সাওয়াব দাবী করতে ভুলে যাওয়া।

 

তিনঃ সিদ্দিকঃ

সাদিক হচ্ছে যে তাঁর কথায় সত্যবাদী আর সিদ্দিক হচ্ছে যে তাঁর সমস্ত কথা, কর্ম ও অবস্থায় সত্যনিষ্ট। ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ত থাকাই সত্যবাদিতা। ইমাম হারিস আল মুহাসেবীকে সত্যবাদিতার নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তিনিই সত্যবাদী, যিনি নিজের অন্তরের পরিশুদ্ধতার জন্য মানুষের হৃদয় থেকে তাঁর প্রতি সমস্ত সম্মানবোধ চলে গেলেও পরোয়া করেন না” তিনি নিজের এক বিন্দু পরিমাণ ভালো কাজ মানুষকে জানাতে চান না কিন্তু মানুষ তাঁর মন্দ কাজ জানাকে অপছন্দ করেন না। এটা অপছন্দ করলে প্রমানিত হবে যে, তিনি মানুষের কাছে বেশি সম্মানের প্রত্যাশা করেন যা সিদ্দিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নয়।  [রিসালাতুল কুশায়রিয়্যাহ]

 

লিখেছেন: ড. মোহাম্মাদ নুরুন্নাবী আল-আযহারী
এসিস্টেন্ট প্রফেসর & হেড,
ডিপার্টমেন্ট ওফ ইসলামীর স্টাডিজ, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

Rate this post