সুরা আল-মুমিনুনের প্রেক্ষিতে মুমিনের ৭টি গুণাবলী- At Tazkiah
সুরার নামঃ আল-মু’মিনুন
সুরা নংঃ ২৩
আয়াত সংখ্যাঃ ১১৮
অবতীর্ণের স্থানঃ মক্কা
সুরার নামকরনঃ
সাধারণত পবিত্র কুরআনের সুরা সমূহের নামকরণের ক্ষেত্রে দুটি দিক পরিলক্ষিত হয়,
এক- বহুল আলোচিত শব্দ (শব্দ ভিত্তিক). যেমন- নাস, ফালাক, হুজরাত ইত্যাদী।
দুই- বিষয়ভিত্তিকঃ যেমন- সুরা ফাতেহা, ইখলাস ইত্যাদী।
অত্র সুরাটির ১ম আয়াতের আল মুমিনুন শব্দ থেকে সুরা “আল-মু’মিনুন” নামকরন করা হয়েছে
অবতীর্ণের সময়কালঃ
সুরাটি মক্কী, অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম মদিনায় হিজরতের পূর্বে নাজিল হয়েছে। তবে ঠিক কোন সময়ে নাজিল হয়েছে তা সঠিক ভাবে বলা য়ায় না তবে বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তু হতে প্রতিয়মান হয় যে, অত্র সুরাটি রাসুল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের মক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিল।
সুরার মূল বিষয়বস্তুঃ
অত্র সুরার মুল আলোচ্য বিষয় সমূহ নিম্নরূপ-
ক। মুমিনদের জন্য সুসংবাদ ও তাঁদের প্রধান ৭টি গুনাবলী। এই বিশেষ গুণাবলী অর্জনকারীরাই ইহকালে ও পরকালে সাফল্য লাভকরবে।
খ। আল্লাহর একাত্ববাদের প্রমাণ ও তাঁর শ্রেষ্টত্ব বর্ণিত হয়েছে।
গ। মানব ভ্রূণ গঠন প্রক্রিয়া ও ক্রমবিকাশ। অত্র সুরায় মানব সৃষ্টির বিভিন্ন স্তরের কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি তোমাদেরকে পরকালে তার সামনে হাজির করতেও সক্ষম।
ঘ। এই সুরায় বিভিন্ন নবী ও তাঁদের জাতী ও তাদের পরিনতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যাতে দুনিয়াবাসী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের আনুগত্য করে, আল্লার বিধানকে মেনে নেয় ও একমাত্র তারই ইবাদত করে।
ঙ। অবিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর সতর্কতা ও তাঁদের শেষ পরিণতি।
চ। মু’মিনদের প্রতি অবিশ্বাসীদের অত্যাচার ও দুরভিসন্ধির ব্যাপারে আল্লাহ তায়লা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলিহি ওয়াস সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের জন্য নির্দেশনা প্রদান, যেমন আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা এবং ধৈর্য ও দয়ার সাথে প্রত্যাখ্যানের জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ছ। পরকাল এবং জবাবদিহিতা। সূরাটিতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা রয়েছে যে, মু’মিন ও অবিশ্বাসীগণ তাঁদের কৃতকর্মের জন্য প্রতিদান প্রাপ্ত হবে।
জ। একাত্ববাদের প্রতি আহ্বান: সূরাটিতে বারবার আল্লাহর একত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাঁর গুণাবলী ও নিদর্শনগুলোর প্রতি প্রতিফলন করার আহ্বান করা হয়েছে।
সুরা আল মুমিনুনের ফজিলতঃ
হযরত উমর (রাঃ) বলেন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের প্রতি যখন অহি অবতীর্ণ হতো তখন মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ শুনা যেত। একদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা অহি শুনার জন্য থেমে গেলাম। অহির বিশেষ এ অবস্থার শেষ হলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম কেবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন এবং দোয়া, করতে লাগলেন,
اَللّهُمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تُهِنَّا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمْنَا وَآثِرْنَا وَلَا تُؤْثِرْ عَلَيْنَا وَاَرْضِنَا وَارْضَ عَنَّا
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে সব কিছু বৃদ্ধি করে দাও হ্রাস করোনা। আমাদের সম্মানিত করো- লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান কর-বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে ক্ষমতা দাও, কাউকেও আমাদের বিপক্ষে ক্ষমতা দিও না। তুমি আমাদেরকে খুশী করো, আমাদের প্রতিও তুমি খুশী থাকো।)।
অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এখন আমার ওপর দশটি আয়াত অবতীর্ণ হলো, যে ব্যক্তি এ আয়াত গুলো বাস্তবায়ন করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিলাওয়াত করতে লাগলেন, (সূরা মু’মিনূন-এর শুরু হতে) ’’কাদ্ আফলাহাল মু’মিনূন’’ (অর্থাৎ- মু’মিনগণ কৃতকার্য হয়েছে)- এভাবে দশটি আয়াত (তিলাওয়াত) শেষ করলেন। [তিরমিযী, হাঃ নং-৩১৭৩]
ইমাাম নাসায়ী তফসীর অধ্যায়ে ইয়াযিদ ইবনে কাবনুস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করা হয় যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন তার চরিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে বললেনঃ এগুলোই ছিল রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চরিত্র ও অভ্যাস। (ইবনে কাসীর)
শানে নুযূল/পটভূমিঃ
অত্র সুরা বিশেষ করে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো নাজিলের মক্কার কাফেররা যেমন ছিল ইসলামের চরম বিরোধী তেমনি পার্থিব উপকরণ সব ছিল তাদের হাতের মুঠোয় (বাণিজ্য)। অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। (আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানগত)
এই অবস্থায় কাফেররা নিজেদের অধিক সফল এবং মুসলমানদের ব্যর্থ মনে করত। তখন মুমিনদের প্রকৃত সফলতার ঘোষণা দিয়ে এ আয়াতগুলি নাজিল করেন।
প্রকৃত সফলতার অর্থ ঃ তাফসীর কারকগণ ব্যাখ্যা করেছেন কোন একটি সুন্দর দালানে এক ব্যক্তি ৫দিন থাকতে পারবে এবং যদি কুড়েঘরে থাকে তবে সারাজীবন থাকতে পারবে- এক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান কোনটি বেছে নেবে।
অথচ আখেরাতে চিরজীবনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা আছে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাঃ
অর্থঃ নিশ্চয়ই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ।
এখানে মুমিন বলতে যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের প্রতি ঈমান এনেছে ও তার আনীত বিধান মেনে নিয়েছে এবং তাঁর দেখানো জীবনপদ্ধতি অনুসরন করেছ তারাই “নিশ্চিতভাবেই সফলতা লাভ।”
সুরাটি “নিশ্চিতভাবেই সফলতা লাভ।” বাক্য দ্বারা শুরু করার তাৎপর্য হল তৎকালীন আরবে কাফিরদের ইসলাম বিরোধীতা এবং তাঁদের বস্তুবাদী জীবনধারা যা তাদেরকে সত্য অন্বেষণ থেকে দূরে রেখেছিল। আল্লাহ তায়লা অত্র আয়াতের মাধ্যমে মু’মিনদের সুসংবাদ ও তাঁদের করণীয় এবং অবিশ্বাসীদেরকে জানান দেয়ার জন্য যে, আল্লাহর নিকট সফলতার মানদন্ড ঈমান, অর্থ নয়। প্রকৃত সাফল্য আখেরাত। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়লা সেসব মুমিনকে সাফল্য দান করার কথা বলেছেন তাঁরা আয়াতমালায় উল্লিখিত সাতটি গুনে গুনান্বিত।
মুমিনদের সাতটি গুনঃ
ইহকাল ও পরকালীন সাফল্যের সর্বপ্রথম শর্ত হল ঈমান। প্রথম আয়াতে মু’মিনদেরকে কিন্তু এটা একটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুনের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুন বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথম গুনঃ
الَّذِينَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ
অর্থ্যাৎ ‘যারা তাদের নামাযে বিনয়ী ও নম্র।”
নামাযে খুশু বলতে বিনয় ও নম্র হওয়া বুঝায়। খশুর আভিধানিক অর্থ স্থিরতা। তবে এখানে শারীরিক ও অন্তরের স্থিরতার কথা বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃত ভাবে না করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থির রাখা।
আমরা জানি আদাবের মাধ্যমেই ইবাদাতের পরিপূর্ণতা ঘটে। আদব বিহীন নামাজ শুধুমাত্র শারীরিক নামাজ হয়ে থাকে। নামাজে আমাদের শরীর, মন ও অন্তরের সম্মীলন আবশ্যক আর এতেই একাগ্রতা আসে। নামাজ সহিহ শুদ্ধ হওয়া না হওয়া বাহ্যিক বিধিবিধান পালনের উপর নির্ভর করে আর নামাজ কবুল হওয়া না হওয়া নির্ভর করে নামাজের আদবের উপর। সুতরাং নামাজে আদবের গুরুত্ব অপরিসীম। ফুকাহায়ে কিরাম নামাজের বাহ্যিক বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করেছেন আর সুফিয়ায়ে কিরাম নামাজের আদব নিয়ে আলোচনা করেছেন কারণ ফুকাহায়ে কিরামের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানব শরীর অর্থাৎ একজন মানুষের কাজ কর্ম, দায়িত্ব, লেনদেন ইত্যাদির শরয়ী হুকুম বর্ণনা করা আর সূফীরা অন্তরের ব্যাধি ও প্রতিকার, পরিশুদ্ধতা অর্জন এবং শরিয়তের বাহ্যিক বিধিবিধান পালনের সাথে সাথে প্রতিটি কাজে আদবের সংমিশ্রণ ঘটানো। প্রতিটি ইবাদাতে বাহ্যিক বিধিবিধান ও অভ্যন্তরীণ আদবের জ্ঞানার্জন অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ী রহ বলেন, তুমি শুধু ফকিহ কিংবা শুধু সূফী হয়ো না। আমি তোমাকে আল্লাহর জন্যই এই ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছি। ঐ ব্যক্তি [ফকিহ] রুক্ষ, যার হৃদয় তাকওয়ায় সিক্ত হয়নি। আর এই ব্যক্তি [সূফী] অজ্ঞ, কিভাবে [শরিয়তের বিধিবিধানে] একজন অজ্ঞ ব্যক্তি নেককার হবে?
আদাব হচ্ছে ইবাদতের প্রাণ। আদব বিহীন ইবাদত অনেক সময় আমাদেরকে আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য থেকে দূরে সরে দেয়। নামাজের কিছু আদব নিম্নে আলোকপাত করা হল।
স্থিরতা, বিনয়নাবত ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে নামাজ আদায় করাঃ আমিত্বকে ভেঙে মুনিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, আসামির হালতে নামাযে দণ্ডায়মান হয়ে স্রষ্টার প্রেমে বিভোর হয়ে নামাজ আদায় করা। ইমাম আলী যাইনুল আবেদীন (রাঃ) যখন অযু করতেন এবং নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিতেন তখন তাঁরা চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো [শরীরে] কম্পন সৃষ্টি হতো। এব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, হায়! তোমরা কি জানো আমি কার সামনে দণ্ডায়মান হচ্ছি এবং কার সাথে কথোপকতন করবো? ইমাম শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘নামাজের মূল উপাদান তিনটি ১. নামাজে আল্লাহ পাকের অনন্ত অসীম মহত্ত¡, বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের চিন্তায় বিভোর থাকা। ২. আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত¡ উত্তম শব্দমালার দ্বারা জবানে প্রকাশ করা। ৩. দাঁড়ানো, বসা, রুকু, সেজদার মাধ্যমে নিজের অক্ষমতা, অপারগতা, দাসত্বের সাক্ষ্য প্রদান করা।
মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করাঃ নামাযে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে নামাজ আদায় করলে তা কখনো পরিপূর্ণ নামাজ হয়না। নামাযে তিলাওয়াত, তাসবীহ, রুকু ও সিজদাহর বিধান সব কিছুর উদ্দেশ্য হল আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন আর প্রশংসা ও সম্মান অবচেতন মনে হয় না। নামাযে অন্তঃনিহিত আল্লাহর প্রতি সম্মান ভালোবাসা উপলব্ধি ব্যতিরেক নামাজ হচ্ছে শুধু মাত্র শারিরিক নামাজ আর এই শারিরিক নামাজকেই কি দ্বীনের স্তম্ভ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে!? আল্লাহর প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা ও সম্মান বিহীন নামাজকে কখনো মুসলিম ও কাফেরে মাঝে পার্থক্যকারী হতে পারে না। ইমাম হাসান বসরী (রহ) বলেন, যে নামাযে অন্তরের স্থিরতা ও মনোযোগ থাকেনা সেটি শাস্তির অধিক উপযোগী। হযরত রাবিঈ ইবনু খুসাইম (রাঃ) বলেন, যখনই নামাজে দণ্ডায়মান হয়েছি আমি যা তিলাওয়াত করি বা পড়ি তা ব্যতীত কিছুই আমার হৃদয়ে জাগ্রত হয়নি।
মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করাঃ
সাহাবা, তাবেয়ী ও আল্লাহ প্রেমিকদের নামাজের আদব নিয়ে নিম্নে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হল,
নামাযে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী ও আল্লাহর প্রিয়বান্দাদের অবস্থাঃ
নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় এসেছে, বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন মনে হত একটি কাঠ মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রখ্যাত তাবেয়ী আ’মাশ রাহ. থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. যখন নামাযে দাঁড়াতেন তাকে দেখে মনে হত যেন একটি পড়ে থাকা কাপড়।
এমনভাবে নামাজ পড়া যেন আল্লাহকে দেখছি নতুবা আল্লাহ আমাকে দেখছেন। বস্তুত এমন নামাজই মানুষকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কর্ম থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৫)
বর্তমানে অনেক নামাজ আদায়কারীকে প্রকাশ্যে অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে দেখা যায়। হজরত ইমরান ইবনে হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন, ‘যার নামাজ তাকে অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত না রাখে সে নামাজ তাকে আল্লাহ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়।’
বিশিষ্ট সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে দ্বীনের কিছু কথা বলে দিন। জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যখন নামায পড় তখন জীবনের শেষ নামায আদায়কারীর মতো নামায পড়।
সহীহ বুখারীতে এসেছে, সাহাবী আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন সে আল্লাহর সাথে একান্তে কথা বলে; যতক্ষণ সে তার নামাযের জায়গায় থাকে।
ইমাম হাফেজ আবু যুরয়া আর-রাযী (রহ) ছিলেন বিখ্যাত হাদিস বিশারদ। তিনি ইমাম মুসলিম, তিরমিজী, নাসায়ীর উস্তাদ। ইমাম যাহাবীর ভাষায় তিনি হচ্ছেন, “সায়্যিদুল হুফফাজ”! বায়হাকী ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবু যুরয়া ছয় লাখ হাদিসের হাফেজ”!
ইমাম আবু যুরয়া রাজী এক মসজিদের ইমাম। নামাজ পড়াচ্ছেন, ২০ বছর যাবত। একদিন তার কাছে কিছু মুহাদ্দিস আসলেন হাদিসের দরস নিতে। নামাজ শেষ হলো। তারা প্রশ্ন করলেন,
– আচ্ছা শায়েখ! নামাজরত ব্যক্তির সামনে যে মেহরাব রয়েছে তাতে কোন কিছুর লেখার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
– এটাকে আমি অপছন্দ করি। পূর্ববর্তীরাও অপছন্দ করতেন।
– কিন্তু শায়েখ, আপনার মেহরাবে যে কিছু বাক্য লেখা রয়েছে।
– সুবাহানাল্লাহ! আমি তো জানিই না।
-আশ্চর্য! এখানে আপনি এতবছর নামাজ পড়ছেন, তবুও দেখেন নি?
– ইমাম আবু যুরয়া বললেন “সুবাহানাল্লাহ! এটা কীভাবে সম্ভব যে বান্দা আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, আবার তার সামনে কী লেখা আছে সেটাও দেখবে!!?
অতঃপর ছাত্ররা জিজ্ঞেস করলেন,
– নামাজে আপনার এই স্থিরতা ও একাগ্রতা নিশ্চয়ই বিশর বিন হারেস ও আহমদ বিন হানবলের সান্নিধ্যের বরকতে হয়েছে?
ইমাম রাজী উত্তর দিলেন- না! তা একজন সুফীর সোহবতের বরকতে হয়েছে। কিছুদিন আমি যার সান্নিধ্যে থেকেছি। তবে নিঃসন্দেহে বিশর ও আহমদ ইবন হাম্বলের উম্মাহর ইলমের সর্দার কিন্তু তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্র সুফীর জ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে ভিন্ন।
হযরত সাইদ ইবনে জুবাইর রহ, যখন নামাজ পড়তেন, তখন মনে হত যেন একটা লোহার পেরেক স্থির হয়ে আছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, ইবরাহীম তাইমী রহ, সেজদা করছেন। আর পিঠে চড়ুই এসে বসে রয়েছে। যেন একটা খড়ি! কোন নড়াচড়া নেই, পূর্ণ মনযোগে সালাত আদায় করছেন।
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত মুসলিম ইবনে ইয়াসার (রাঃ) নামাযে মগ্ন। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে আগুন লেগে গেল। লোকজন হইচই শুরু করল, কিন্তু তিনি নামাজেই ধ্যানমগ্ন। অনুভবই করেন নি আগুনের উত্তাপ! শেষপর্যন্ত লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলল। তিনি তার পরিবারকে বলতেন, “আমি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলে, তোমরা তোমাদের প্রয়োজনের কথাবার্তা বলতে পারো।” কারণ নামাজে দাঁড়ানোর পর তিনি আর শুনতে পাবেন না।
হুমাইদ ইবন হেলাল ও গাইলান ইবন জারীরের বর্ণনায় এসেছে, হযরত মুসলিম ইবন ইয়াসার যখন নামাযে দাঁড়াতেন তাকে দেখে মনে হত যেন একটি পড়ে থাকা কাপড়।
ইবনে আউন (রহ) বলেন, আমি মুসলিম ইবন ইয়াসারকে নামাজ আদায় করতে দেখেছি মনে হচ্ছিল একটি স্থির খুঁটি। একবার এক পায়ে আরেকবার অন্য পায়ের উপর ভর করার জন্যও একটু কাত হচ্ছেন না। তাঁর পরিধেয় পোশাক পর্যন্ত নাড়াচাড়া করছেনা!
একরাতে ইমাম বুখারী সালাত আদায় করছেন। ভীমরুল এসে তার কানে ১৭ বার দংশন করল। অথচ তিনি অনুভবই করেন নি। নামাজ শেষে হঠাৎ তার মনে হলো, তার কানে হয়ত কিছু লেগেছে। বললেন “দেখো তো, আমাকে কিসে দংশন করেছে?”!
ইমাম মোহাম্মদ বিন খাফীফ! ইলম ও আমল আর আ’লা সনদের কারণে ইতিহাসে স্মরণীয়! ইমাম যাহাবীর ভাষায় “আশ শায়খুল ইমামুল আরেফ, আল ফকীহুল কুদওয়াহ, যুল ফুনুন”! তিনি বিশিষ্ট সুফী ছিলেন, তিনি বলেনঃ আমার প্রথমিক অবস্থায় হয়তো এক রাকাতে দশ হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করেছি। মাঝে মধ্যে এক রাকাতেই পুরো কুরআন তিলাওয়াত করতাম।
একদিন তিনি কোমরে সাংঘাতিক ব্যাথা পেলেন। উঠে দাঁড়াতে গেলেই বসে পড়েন। এরপরেও যখন আযানের ধ্বনি ভেসে আসে, কারো কাধে ভর করে মসজিদে যান। জামাতের সাথে সালাত আদায় করেন।
একবার তাকে বলা হলো, ‘আপনি নিজের প্রতি একটু যত্ন নেন। এভাবে কষ্ট করছেন কেন? তার উত্তর ছিল… “যখন তোমরা ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ শুনতে পাবে, অথচ দেখবে যে আমি কাতারে উপস্থিত নই। তখন তোমরা আমাকে গোরস্তানে তালাশ করো!”
এভাবে আল্লাহর বিশিষ্ট বান্দাদের থেকে নামাজে একাগ্রতা, স্থিরতা ও মগ্নতার অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। যারা শরীর, মন ও অন্তর দিয়ে আল্লাহর ইবাদাত করেছেন। ইবাদাতের বাহ্যিক আহকাম ও অভ্যন্তরীণ আদাবের সমন্বয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দার স্থরে উপনীত হয়েছেন।
দ্বিতীয় গুনঃ
وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ
অর্থাৎ ‘যারা অনর্থক কাজ ও কথা থেকে দুরে থাকে।’
اللَّغْوُ বলা হয় এমন প্রতিটি কাজ এবং কথাকে বুঝায় যা অপ্রয়োজনীয়, অনর্থক, অর্থহীন ও নিস্ফল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُه مَالَا يَعْنِيْهِ
“মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন ইসলাম সৌন্দর্যমন্ডিত হয়”
আল্লাহ বলেন-
وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا
অর্থ্যাৎ- “যখন এমন কোন জায়গা দিয়ে তারা চলে যেখানে বাজে কথা হতে থাকে অথবা বাজে কাজের মহড়া চলে তখন তারা ভদ্রভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়।” ( ফুরকান-৭২)
অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের অসংখ্য নির্দেশনা এসেছে যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ .
যে আমাকে তার দুই চোয়ালের মাঝের অঙ্গ অর্থাৎ যবান এবং দুই পায়ের মাঝের অঙ্গের (সঠিক ব্যবহারের) যামানত দিবে আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হব।
হযরয়ত উকবা ইবনে আমের (রা.) একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লমকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল! নাযাত বা পরিত্রান কীসে? উত্তরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম সর্বপ্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ করলেন তা হল-
أمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ.
তুমি তোমার যবানের নিয়ন্ত্রণ কর।
একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা) একাকী পেয়ে জান্নাতে প্রবেশকারী আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি বলেন, একবার নবীজীর সাথে কোনো এক সফরে ছিলাম। পথিমধ্যে নবীজীকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
يَا رَسُولَ اللهِ أَخْبِرْنِي بِعَمَلٍ يُدْخِلنِي الجَنَّةَ وَيُبَاعِدنِي عَنِ النَّارِ.
হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম তাকে দীর্ঘ উপদেশ দিলেন, এক পর্যায়ে বললেন,
أَلاَ أُخْبِرُكَ بِمَلاَكِ ذَلِكَ كُلِّهِ؟ قُلْتُ: بَلَى يَا نَبِيَّ اللهِ، فَأَخَذَ بِلِسَانِهِ قَالَ : كُفَّ عَلَيْكَ هَذَا، فَقُلْتُ : يَا نَبِيَّ اللهِ! وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ؟ فَقَالَ : ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَاذُ، وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلاَّ حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ.
আমি এসব কিছুর মূল কী তা আমি কি তোমাকে বলে দিব? আমি বললাম, হ্যাঁ হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি নিজের জিহ্বা ধরে বললেন, এটাকে সংযত কর। এ কথা শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আমাদের কথাবার্তার জন্যও কি কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বললেন, আরে! যবানের কামাই-ই তো মানুষকে অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে!
হাঁ, যবানই আমাদেরকে জাহান্নামের পথে ধাবিত করে। এই যবান দ্বারা মিথ্যা, পরচর্চা, পরনিন্দা, অহংকার, অপবাদ, অভিযোগ ও হারাম ভক্ষন করে মানুষের অধিকার হরণ করি যা আমাদের সমস্ত আমলকে ধংস করে দেয়। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরসাদ করেন,
إِنَّ العَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللَّهِ، لاَ يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَرْفَعُهُ اللَّهُ بِهَا دَرَجَاتٍ، وَإِنَّ العَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللَّهِ، لاَ يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ.
বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কথা বলে, যেদিকে সে খেয়ালই করে না, কিন্তু এর কারণে আল্লাহ তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন। আবার বান্দা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার মত কথা বলে, যেদিকে সে ভ্রুক্ষেপই করে না; কিন্তু তা তাকে জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়।
আমরা যা কিছু বলছি তাই লিপিবদ্ধ হচ্ছে সুতরাং বলার পূর্বে অবশ্যই ভেবে চিন্তে বলা আবশ্যক। অনেক সময় আমাদের গুরুত্বহীনভাবে বলা কথাও আমাদের অনেক বড় ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
اِذْ یَتَلَقَّی الْمُتَلَقِّیٰنِ عَنِ الْیَمِیْنِ وَ عَنِ الشِّمَالِ قَعِیْدٌ، مَا یَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ اِلَّا لَدَیْهِ رَقِیْبٌ عَتِیْدٌ.
স্মরণ রেখ, দুই গ্রহণকারী ফিরিশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে; মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত। -সূরা কাফ, আয়াত: ১৭-১৮
সালাফে সালেহীনগণ তাঁদের যবান সংরক্ষণে যথেষ্ট সতেষ্ট ছিলেন। ইমাম হাসান বসরী (রহ) বলেন, কথা যদি সোনা তুল্য হয় তাহলে নিরবতা রূপা তুল্য আর কথার মূল্য যদি রূপা তুল্য হয় তাহলে চুপ থাকাটা সোনা তুল্য। ইমাম সুফিয়ান ছাওরী (রাহ.) একদিন তাঁর সঙ্গীদের বললেন-
لَوْ كَانَ مَعَكُم مَنْ يَرْفَعُ حَدِيْثَكم إِلَى السُّلْطَانِ، أَكُنْتُم تَتَكَلَّمُوْنَ بِشَيْءٍ؟
তোমাদের সঙ্গে যদি এমন কেউ থাকে, যে তোমাদের কথা সুলতানের কাছে পৌঁছে দিবে, তোমরা কি কোনো কথা বলবে?
সঙ্গীরা বললেন- জী না
তিনি তখন বললেন-
فَإِنَّ مَعَكُم مَنْ يَرْفَعُ الحَدِيْثَ.
তাহলে জেনে রেখ, তোমাদের সাথে এমন কেউ আছেন যারা কথা পৌঁছান। অর্থাৎ ফেরেশতাগণ।
তৃতীয় গুনঃ
وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ
“যারা যাকাত বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়।
আরবী ভাষায় যাকাত শব্দের অর্থ হল,
১। পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা, পরিশুদ্ধি।
২। বিকাশ সাধন, সমৃদ্ধ করা।
৩। পারিভাষিক অর্থে যাকাত হচ্ছে, মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় তবে, গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করাকে যাকাত বলা হয়।
অত্র সূরাটি পবিত্র নগরী মক্কায় অবতীর্ণ হয় আর যাকাত ফরজ হয়েছে পবিত্র নগরী মদিনাতে সুতরাং কারো কারো মোটে এখানে যাকাত বলতে সামগ্রিক ভাবে পরিশুদ্ধতাকে বুঝানো হয়েছে। অথবা যাকাত দ্বারা শুধু মাত্র সম্পদের পরিশুদ্ধতাকে বুঝানো হয়নি
আত্মার পরিশুদ্ধি
চরিত্রের পরিশুদ্ধি
জীবনের পরিশুদ্ধি
পারিবারিক পরিশুদ্ধি
সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি ত্যাদীকে বুঝানো হয়েছে।
উপরোক্ত প্রত্যেকটি দিকের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত এর ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়া এর অর্থ কেবল নিজেরই জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। না বরং নিজের চারপাশের জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে।
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى
অর্থ্যাৎ- “কল্যাণ ও সফলতা লাভ করল সে, যে পবিত্রতার কাজ করলো এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়লো।” (সুরা আ’লা: ১৪, ১৫)
আল্লাহ তায়লা আরো ইরসাদ করেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا
“সফলকাম হলো সে, যে নিজের নফসকে পবিত্র বা তাযকিয়া করলো। আর ব্যর্থ হলো সে যে নিজেকে কলুষিত করল।” (সুরা আশ শামস:৯,১০)
এ আয়াতে গোটা সমাজ জীবনের কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থ গুণঃ
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ
‘যারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করেন।
বিবাহ বহির্ভূত সকল প্রকার শারীরিক সম্পর্ক কিংবা অবৈধ সম্পর্কের প্রতি আন্দোলিত করে এমন প্রতিটি কাজকে ইসলাম হারাম করেছে এবং বৈধ পন্থা ব্যতিরেক অন্য কাউকে কামনা করা হবে সীমালংঘন।
৫ম ও ৬ষ্ঠ গুনঃ
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
‘যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা বা প্রতিশ্রতি রক্ষা করে।’
আমানত প্রত্যাপর্ন করাঃ
পবিত্র কুরআনে আমানত শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। আভিধানিক অর্থে এমন একটি বিষয় শামিল যার দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোন ব্যক্তির উপর আস্থা রাখা যায় ও ভরসা করা যায়। বিধায় আমানত শব্দটি বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত।
দু’ধরনের আমানত সংক্রান্ত কথা-
ক. হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্
খ. হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক।
ক) হক্কুল্লাহঃ
১. শরীয়ত আরোপিত সকল ফরজ ও ওয়াজিব পালন করা এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরুহ বিষয় থেকে দুরে থাকা।
২. মানুষ আল্লাহর খলিফা। খিলাফতের দায়িত্ব পালনের আমানত রক্ষা করা।
খ) হক্কুল ইবাদঃ
১. কোন ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক আরোপিত ধনসম্পদের আমানত।
২. গোপন কথা/ তথ্যের আমানত
৩. পরিবারের সবাই একে অপরের আমানত
৪. প্রতিবেশী আমানত।
৫. চাকুরিতে অর্পিত দায়িত্ব আমানত
৬. মজুর, শ্রমিক ও চাকরীজীবীদের জন্য যে কার্য সময় নির্ধারন করে দেয়া হয় তা পালন
৭. দায় দায়িত্বের আমানত। সংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র, পরিবার পরিচালক হিসেবে।
৮. গণতান্ত্রিক দেশে ভোটারদের ভোট আমানত।
হাক্কুল ইবাদের পরিধি আরো অনেক বিস্তৃত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদরে হাতে ফরেত দবোর নর্দিশে দচ্ছিনে৷ (সূরা নিসা:৫৮)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন: “তার ঈমান নেই যার আমানতদারী নেই।”
তাছাড়া মোনাফেকের যে চারটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ১) ‘কোন আমানত তার কাছে সোপর্দ করা হলে সে তার খেয়ানত করে।’
অঙ্গীকার পূর্ণ করাঃ
অঙ্গীকার বলতে প্রথমত, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বুঝায় যা কোন ব্যাপারে উভয়পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়। এরুপ চুক্তি পূর্ণ করা ফরজ।
দ্বিতীয় প্রকার অঙ্গীকারকে ওয়াদা বলা হয় অর্থ্যাৎ এক তরফাভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেয়ার বা কোন কাজ করে দেয়ার অঙ্গীকার করা।
সপ্তম গুনঃ
وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ
“যারা তাদের নামায সমূহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে।”
এখানে পাঁচওয়াক্ত নামায যথাযথভাবে আদায় করাকে বুঝায়। এখানে নামায সমূহের সংরক্ষণ বলতে নামাযের বাহ্যিক আহকাম ও অভ্যন্তরীণ আদাবের সম্মিলন এবং যাবতীয় নিয়মনীতি যথাযথভাবে পালন করা বুঝানো হয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহ তায়লা ইরসাদ করেন,
﴿أُولَٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ. الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
অর্থঃ তারাই (এসবগুনের অধিকারীগণই) উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফেরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।
লিখেছেন: ড. মোহাম্মাদ নুরুন্নাবী আল-আযহারী
এসিস্টেন্ট প্রফেসর & হেড, ডিপার্টমেন্ট ওফ ইসলামীক স্টাডিজ, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।