সুফি সাধক মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি ও তার প্রেম
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, যিনি রুমি নামেই সারাবিশ্বে পরিচিত, যিনি সুফিবাদ বা তাসাউফের বিশ্বস্ত নাম। যে ধারা ইসলামের সকল ফরয আইন মেনে তার সাথে নিজেদের ধ্যান ধারণা নিয়ে এগিয়ে যায় তাই হলো সুফিবাদ বা তাসাউফ। তাসাউফ সরাসরি মানুষের পরিশুদ্ধার সাথে জড়িত,আত্ম-সম্পর্কীয় আলোচনা যার মুখ্য বিষয়। তাসাউফের মূল কাজ হচ্ছে আপন নফসের সঙ্গে, নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড়জগত থেকে মুক্তি পাওয়া। এর গভীরতা ব্যাপক।
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কবি মাওলানা রুমির নাম ছিল মুহাম্মদ, উপাধি হলো জালালউদ্দিন। বংশীয় সুত্রে তিনি পিতার দিক থেকে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা:) এর সহিত মিলিত হন এবং মাতার দিক থেকে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সাথে মিলিত হন। জালালউদ্দিন রুমি কর্মজীবনে তুরস্কের কোনিয়ায় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন তখন বিশ্বব্যাপী তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আধ্যাত্মিক চর্চা করতেন।
হযরত শামস-ই তাবরিজি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ, তিনি কোন স্থানে স্থায়ী হতেন না। মানুষ তাকে ‘পাখি’ বলে ডাকত। মাওলানা রুমীর আধ্যাত্মিক চর্চার কথা শুনতে পেরে তিনি একজন পরম জ্ঞানী শিষ্য খুজে পাওয়ার আশা করেন। একদিন পথিমধ্যে তিনি মাওলানা রুমির সাক্ষাৎ পান এবং সে প্রশ্ন করেন: ইমানের সংজ্ঞা কি? মাওলানা রুমি নানাভাবে তাকে ইমানের সংজ্ঞা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শামস-ই-তাবরিজি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না এবং বললেন: ইমানের সংজ্ঞা হলো- নিজের থেকে নিজেকে পৃথক করে ফেলা। তার এই উত্তর শুনে মাওলানা রুমি তার অনুগত হয়ে গেলেন। এবং তিনি তার সাথে গভীর ধ্যান সাধনায় লিপ্ত হতে শুরু করলেন। আর শামস-ই-তাবরিজির এই ধ্যান সাধনাকে সমাজ গ্রহণ করতে পারিনি, যখন পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে যাচ্ছিল তখন মাওলান রুমি তার কন্যা কিমিয়াকে শামস তাবরিজির সাথে বিয়ে দেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে শিষ্যের কন্যাকে বিয়ের ঘটনা তার জীবনে এক স্বরণীয় মুহুর্ত ছিল। বিয়ের কয়েক মাস পরেই স্ত্রী কিমিয়া অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অত:পর তাবরিজি যেন আবারও সেই বনের পাখি হয়ে ওঠেন, এবং তিনি আবার ও হারিয়ে যান। এতে মাওলানা রুমি খুব ব্যথিত হন। তাকে হারিয়ে ফেলার শোকে ‘দেওয়ান-এ-শামস-এ-তাবরিজি’ বইটি লিখেন। জালালউদ্দীন রুমী তার এই বিখ্যাত বইতে তার গুরুকে হারানোর যন্ত্রণার কথা বর্ণনা করেন। এই পুস্তকের মাধ্যমে অন্যরকম রুমির আবির্ভার ঘটে। নতুনভাবে তিনি সবার কাছে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। তিনি এ পুস্তকে একে একে কবিতা, গজল লিখতে থাকেন যা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন পাঠ হিসেবে সবার কাছে প্রকাশিত হয়।
শামস তাবরিজির বিরহে তিনি লিখেন:
আমি কেন তাকে খুঁজব?
সে আর আমি তো একই
তার অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে
আমি নিজেকেই খুঁজছি।
মাওলানা রুমি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করলেন। তাসাউফের আলো জ্বালাতে তিনি আরো দুর্বার, দুরন্ত হয়ে উঠলেন। লেখালেখির আগে-পরে ধ্যানের সাথে এমন মগ্নভাবে তিনি ঘুরতে থাকতেন, যেন এই জগত ছেড়ে তিনি অন্য জগতে চলে গিয়েছেন! দেখতে নাচের মতো হলেও নাচের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটা ছিল পৃথিবীর মতো ঘুরতে ঘুরতে স্রষ্টার প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মুহুর্ত, যেন স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার প্রবল ইচ্ছায় ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে থাকার মুহুর্ত, যেমন করে মাওলানা রুমি বলতেন, “সম্মুখে উপস্থিত ছাড়া কোনো প্রার্থনাই পরিপূর্ণ নয়।”
রুমির দেখানো এই মগ্ন হওয়ার ধারা আজও বিদ্যমান সুফি নৃত্য নামে। সুফিবাদের ইতিহাসে এই নতুন আলো দিয়ে সুফিবাদের তত্ত্ব আরও আলোকিত হয়েছে। কারণ সুফিবাদের ইতিহাসে কখনও কেউ নিজেকে ধরে রাখতে চায়নি, বরং চেয়েছে স্রষ্টার কাছে সপে দিতে। রুমি এই মগ্ন থাকার ধারাকে নিজের জন্য আবশ্যিক ভাবতেন। এভাবেই প্রতিদিন নিজেকে সঁপে দিতেন স্রষ্টার কাছে।
এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন,
এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন,
আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।
এভাবেই রুমি তাবরিজিকে হারিয়ে এক অন্য রুমি হয়ে ওঠেন। তার জীবনে পরবর্তীতে নতুন বন্ধু আসে যিনি ছিলেন সালাউদ্দিন জাকুব। পাওয়া-না পাওয়া, প্রেম-বিরহ সবকিছু আরও মেলে ধরে তিনি লিখতে বসেন আরেক বিস্ময়কর গ্রন্থ ‘মাসনবী শরিফ’। শক্তিশালী সব চিন্তা-চেতনা দিয়ে হৃদয় আলোকিত করেছেন মাওলানা রুমি। পরিশেষে শামস তাবরিজির একটি কথা উল্ল্যেখ না করলেই নয়, তিনি বলেন: